ধানের ফলন কমায় শ্যামা পোকার আক্রমণ। এই পোকা পাতার রস খেয়ে গাছ নষ্ট করে দেয়। আবার সঙ্গে নিয়ে আসে টুংরো রোগকেও। ফলে জোড়া আক্রমণে ধানের দফারফা হয়ে যায়। প্রতিকার লিখেছেন বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি কীটতত্ব বিভাগের গবেষক দেবাশিস মণ্ডল ও সামিউল ইসলাম শেখ।
ধান চাষে ভারতবর্ষ সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয়। আর পশ্চিমবঙ্গ সারা ভারতের মধ্যে প্রথম। আমাদের রাজ্যের প্রায় সব জেলাতেই ধান চাষ হয়ে থাকে। কোনও কোনও জায়গায় আবার বছরে সবসময়ই ধান চাষ হয়। ধানের অনেক জৈবিক (Biotic) বা অজৈবিক (Abiotic) কারণে ফলন হ্রাস পায়। তার মধ্যে শ্যামা পোকা একটা অন্যতম কারণ। শ্যামা পোকা বা Green Leaf Hopper যার বিজ্ঞানসম্মত নাম Nephotettix viresence। কালী পুজো বা শ্যামা পুজোর আগে ঝাঁকে ঝাঁকে এই পোকার ব্যাপক বিস্তার ঘটে। তাই এই পোকাকে অনেকে শ্যামা পোকা বলে।
কেন শ্যামা পোকা গুরুত্বপূর্ণ?
এই পোকা সাধারণত ধান গাছেই আক্রমণ করে। ধান আমাদের কাছে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। যার থেকে আমরা প্রতিদিনের খাদ্য গ্রহণ করে থাকি। শ্যামা পোকা যেমন ধান গাছকে আক্রমণ করে ক্ষতি করে, ঠিক তেমনই এটি ভাইরাস ঘটিত রোগও ছড়ায়। যার থেকেও চাষিরা ধানে বিপুল ক্ষতির মধ্যে পড়েন।
কোথায় এবং কেন শ্যামা পোকা দেখা যায়?
ভারতবর্ষের প্রায় সব জায়গায় এই পোকার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে এই পোকা ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। কারণ অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রা ও বৃষ্টি না হওয়া এদের কাছে আদর্শ সময়। ধানের নতুন শিষ বের হলে শ্যামা পোকা ধানের জমিতে আক্রমণ করে। ঘন ধানের জমিতে এবং জমিতে জল থাকলে এই পোকার প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। শ্যামা পোকা ধানের পাতার নিচের দিকের থেকে উপরের দিকেই বেশি আক্রমণ করে এবং ধান গাছের ধারের পাতা এদের কাছে আক্রমণের উপযুক্ত।
কী করে এই পোকা চিনব?
একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ পোকার দৈর্ঘ্য ৪ থেকে ৪.৫ মিলিমিটার হয়ে থাকে। স্ত্রী পোকা আকারে একটু বড় হয়। পরিণত অবস্থায় এদের রঙ হলদে সবুজ ও ডানার নিচের দিক কালো হয়। পরিণত পুরুষ পোকার ডানায় কালো দাগ থাকে। এই পোকার ‘নিম্ফ’ দশাটি অত্যন্ত নরম হয়। এর রঙ হলদে সাদা হয়। যা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবুজ রঙের হতে থাকে। রাতের বেলা লাইটের আলোতে এদের উপদ্রব বৃদ্ধি পায়।
শ্যামা পোকা আক্রমণের লক্ষণ কী?
প্রাপ্তবয়স্ক পোকা এবং তার নিম্ফ (কম বয়সি দশা) দুটিই ধানের জমিতে আক্রমণ করে ও গাছের পাতা থেকে রস শোষণ করে। ফলে মনে হয় গাছের পাতাগুলি আগুনে পুরে ঝলসে গেছে। যার ফলস্বরূপ গাছ মারা যায় ও ফলনের অধ্যধিক হ্রাস ঘটে।
টুংরো রোগের লক্ষণ কী?
এই রোগে আক্রান্ত ধান গাছের পাতা হলুদ বা কমলা রঙের হয়ে যায়। ধান গাছের ডগার দিক থেকে এই হলুদ রঙ গোড়ার দিকে ছড়িয়ে পরে। আক্রান্ত পাতার উপর অনেক দাগ দেখা যায়। চাষিরা এই লক্ষণ দেখে অনেক সময় বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন এর সঠিক কারণ নিয়ে। অনেকে এটা নাইট্রোজেন বা জিঙ্কের অভাবজনিত কারণও মনে করেন। তাই টুংরো রোগ হয়েছে কিনা জানার জন্য শ্যামা পোকার উপস্থিতি অবশ্যই জানতে হবে।
এছাড়াও একটি অন্য পদ্ধতিতে এই রোগ নির্ণয় করা যায়। ১০০ মিলিলিটার জলে ২ গ্রাম আয়োডিন এবং ৬ গ্রাম পটাশিয়াম মিশিয়ে একটি রাসায়নিক মিশ্রণ বানাতে হবে। ওই মিশ্রণে ধানের পাতার ডগার দিকের ১০ সেন্টিমিটার ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। তারপর পাতাটি ভাল করে ধুয়ে তাতে নীল দাগ দেখা দিলে টুংরো রোগ নিশ্চিত করা যাবে।
প্রতিকারের উপায় কী?
টুংরো রোগ দমনে কোনও উপায় না থাকলেও জমির সঠিক পরিচর্যা এবং জৈবিক বা যান্ত্রিক বা রাসয়নিক পদ্ধতিতে শ্যামা পোকা ও টুংরো রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আগাম ধান গাছ রোপণ করলে শ্যামা পোকার আক্রমণ এড়িয়ে যাওয়া যাবে। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি নাইট্রোজেন ঘটিত সার যেমন ইউরিয়া দিলে এই পোকার আক্রমণ বেশি হয়। তাই পরিমিত ইউরিয়া দিতে হবে তাতে খরচেও সাশ্রয় হবে। ধানের জমির আশেপাশে থাকা আগাছা ও জমির আলের ঘাস কেটে নিয়মিত পরিস্কার রাখতে হবে। কারণ ধান কাটার পর শ্যামা পোকা এই ঘাস ও আগাছায় থেকে বংশবিস্তার করে।
যান্ত্রিক পদ্ধতিতে আলোকফাঁদ ব্যবহার করে শ্যামা পোকাকে আকৃষ্ট করে মেরে ফেলতে হবে। নিমযুক্ত কীটনাশক বা নিম বীজের নির্যাস ও উপকারী ছত্রাক ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে ফসলের গুণগত মানও বজায় থাকে। এছাড়াও বাজারজাত অনেক রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ করে শ্যামা পোকা দমন সম্ভব। কুইনালফস ২৫ ইসি ১.৫ থেকে ২.৫ মিলিলিটার প্রতি লিটার জলে বা সাইপারমেথ্রিন ২৫ ইসি ০.৫ মিলিলিটার প্রতি লিটার জলে বা মনোক্রোটোফস ৩০ শতাংশ এসএল ১ মিলিলিটার প্রতি লিটার জলে গুলে জমিতে স্প্রে করলে পোকার আক্রমণ কমানো যাবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.