ফুলচাষি ও বাগান প্রেমিকদের জন্যে ডালিয়া একটি আকর্ষণীয় ফুল। ডালিয়া সাধারণত অক্টোবর (শরৎ)-এর শেষের দিকে রোপণ করা হয়। চারা লাগানোর পরে কয়েকটি রোগ গাছের ভীষণ ক্ষতি করে। ফলে আশানুরূপ ফুল পায় না। রোগমুক্ত ডালিয়া ফুলের চাষ করাটাই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চাষি ও বাগান প্রেমিকদের জন্য ডালিয়ার রোগ ও তার প্রতিকার নিয়ে লিখেছেন বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের গবেষক উজ্জ্বল সরকার।
ডালিয়া (Dahlia pinnata) হল কন্দযুক্ত, ভেষজ বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ যা আমাদের দেশে মূলত শীতকালীন ফুল হিসাবে চাষ করা হয়। এটির উৎপত্তিস্থল মূলত মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকায়। ডালিয়ার হাইব্রিড সহ মোট ৪২ টি প্রজাতি রয়েছে এবং ৫৭ হাজারেরও বেশি নিবন্ধিত জাত রয়েছে। ডালিয়ার মোট ১৪টি বিভিন্ন ধরনের ফুল রয়েছে, যেমন: একক ফুলের ডালিয়া (টুইনিংস আফটার এইট), অ্যানিমোন-ফুলযুক্ত ডালিয়া (বুগি ওগি), কোলেরেট ডালিয়া (আপেল ব্লসম ), ওয়াটারলিলি ডালিয়া (ক্যামেও), আলঙ্কারিক বা ডেকোরেটিভ ডালিয়া (বার্লিনার ক্লিন), বল ডালিয়া ( বারবেরি বল ), পম্পন ডালিয়া (স্মল ওয়ার্ল্ড ), ক্যাকটাস ডালিয়া (কারমা সাংরিয়া), সেমি ক্যাকটাস ডালিয়া (মিক্স পেপারমিন্ট), ইমব্রিয়েটেড ডালিয়া (মার্লিন জয়), ইঙ্গেল অর্কিড (স্টার) ডালিয়া (অ্যালোওয়ে ক্যান্ডি), ডাবল অর্কিড ডালিয়া (পিঙ্ক জিরাফ), পিওনি-ফুলযুক্ত ডালিয়া (বিসুপ অফ ল্যান্ডাফ), এবং অন্যান্য ডালিয়া (মুনফায়ার) ইত্যাদি।
ফুলের আকারের উপর ভিত্তি করে ডালিয়াকে ৮ টি ফুলের শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে, যেমন, বামুন বেডডার (ব্যাস ৬০০ মিমি বা কম, প্রেস্টন পার্ক), লিলিপুট ডালিয়া (ব্যাস ৩০০ মিমি বা কম, হারভেস্ট টিনি টট), দৈত্যাকার ফুল (ব্যাস ২৫০ মিমি), বড় ফুল ( ২০০-২৫০ মিমি ব্যাস), মাঝারি-ফুল (ব্যাস ১৫৫ – ৩৫০মিমি), ছোট-ফুল (ব্যাস) ১১৫-১৫৫ মিমি), ক্ষুদ্র-ফুল (৫০-১১৫মিমি ব্যাস), ও পম্পোম-ফুল (৫০-১১৫মিমি) ইত্যাদি।
পশ্চিমবাংলায় ডালিয়ার মূলত ৩ ধরনের রোগ দেখতে পাওয়া যায়:
১) অ্যাস্টার ইয়েলোস:
শীতল ও আর্দ্র আবহাওয়া অ্যাস্টার ইয়েলোস বিস্তারের জন্যে আদর্শ। এই রোগটি একটি বাহক পোকা, লিফহপারের দ্বারা ছড়ায়। রোগটির লক্ষণ অনুযায়ী পাতাগুলি তুলনামূলক ছোট, ফ্যাকাশে সবুজ থেকে হলুদ বর্ণের হয় ও ফুলগুলি ছোট এবং সবুজ রঙের থেকে যায়। ঋতুর প্রথম দিকের আক্রান্ত গাছগুলি বেঁটে, ও পাতলা কাণ্ডগুলির উপরের দিকে সন্নিবেশিত হয়ে যায় যেটাকে আমরা উইচেস ব্রোম (Witche’s broom) বলে থাকি।
রোগটি নিরাময়ে নিন্মলিখিত পদক্ষেপগুলি সুপারিশ করা হলো :
ক) ঋতুর প্রথম দিকের আক্রান্ত গাছগুলি উপড়ে ফেলে দিন এবং বাগানে পরে থাকা অবশিষ্টাংশগুলিকেও নষ্ট করে ফেলুন।
খ) বাগান থেকে বহুবর্ষজীবী আগাছা তুলে বাগানটি পরিষ্কার রাখুন। কারণ আগাছাগুলো সংক্রমিত থাকলে, পরের মরশুমে পুনরায় ডালিয়াকে আক্রান্ত করবে।
গ) মালচিং ব্যবহার করুন যেটি লিফহপারকে ভ্রমিত করে সংক্রমণের হার কমাতে সাহায্য করবে।
ঘ) বাগানের সীমারেখা বরাবর ভুট্টা বা গাঁদাফুল লাগান যা লিফহপারেকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
ঙ) অতিরিক্ত মাত্রায় ছড়িয়ে গেলে লিফহপারকে নিয়ন্ত্রিত করতে নিন্মলিখিত যে কোনও একটি কীটনাশক ব্যবহার করুন ইমিডাক্লোপ্রিড ২০০ এসএল (০.৩ মিলি প্রতি লিটার জলে), থাইওমিথোক্সাম ২৫% ডব্লিউ জি (১-২ গ্রাম প্রতি লিটারে), ইথোফেনপ্রক্স ১০% ইসি (১.৫ মিলি প্রতি লিটার জলে), ম্যালাথিয়ন-৫% ডিপি (১.৫ মিলি প্রতি লিটার জলে), অ্যাসিফেট ৫০% ডব্লিউপি (২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে), বা মনোক্রোটোফস ৩৬% এসএল (২.৫ মিলি প্ৰতি লিটার জলে) স্প্রে করুন।
২) ধূসর ছাঁচ বা গ্রে মোল্ড:
ঠান্ডা ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। রোগটি মূলত বাড়ন্ত কুঁড়ি ও পাতায় দেখা যায়। এই রোগটিতে ফুলের কুঁড়ি বাদামি ও বিবর্ণ হয় এবং ফুল ফোটার আগেই কুঁড়িগুলো শুকিয়ে পড়ে যায়। রোগটির মাত্রা বেড়ে গেলে পাতায় ও কাণ্ডে বাদামি রঙের ক্ষত এবং পাতার কিনারার দিকে ধূসর ছোপ দেখা যায়। এই ধূসর দাগগুলিতে অসংখ্য ছত্রাকের স্পোর থাকে যা বাতাসের মাধ্যমে বাগানে ছড়িয়ে রোগ বৃদ্ধি করে থাকে।
এই রোগটির প্রতিকার:
ক) প্রাথমিকভাবে রোগাক্রান্ত কুঁড়ি ও পাতাগুলিকে ছিঁড়ে ফেলুন এবং অবশিষ্টাংশকে নষ্ট করে দিন।
খ) বাগানটি নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন।
গ) বাগিচায় পর্যাপ্ত পরিমাণে বায়ু চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট দূরত্বে চারা লাগান।
ঘ) অত্যধিক মাত্রায় রোগটি ছড়ালে ১০ থেকে ১৫ দিন অন্তর ছত্রাকনাশক যেমন কার্বেন্ডাজিম ৫০ ডাব্লুপি (২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে ) অথবা থায়োফেনেট মিথাইল ৭০% ডাব্লুপি (০.৫ গ্রাম প্রতি লিটার জলে ) অথবা ইপ্রডিওনে ২৫% + কার্বেন্ডাজিম ২৫% ডাব্লুপি (১ গ্রাম প্রতি লিটার জলে) দিয়ে ১ থেকে ২ বার স্প্রে করুন।
ঙ) ফুলের বৃদ্ধিকালীন অবস্থায় শীতল আবহাওয়া বা অসময়ে বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলে আগাম ছত্রাকনাশক স্প্রে করুন।
৩) পাউডারি মিলডিউ:
একটু বাড়ন্ত গাছে সাধারণত এই রোগটি বেশি দেখা যায়। লক্ষণ অনুযায়ী পাতার উভয় পৃষ্ঠে ধূসর থেকে সাদা বৃত্তাকার অনিয়মিত ছোপ, ডালপালায় এবং ফুলের উপরে ধূসর আস্তরণ দেখে এই রোগ চিহ্নিত করা হয়। আক্রান্ত পাতাগুলো ধীরে ধীরে হলদেটে হয়ে শেষ পর্যন্ত ঝরে যায়। রোগের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে, এই সাদা স্পোরগুলি বাগানের অনান্য ফুল বা পাতাগুলির উপর সাদা আস্তরণ বিস্তার করে থাকে। রোগের আক্রমণের তীব্রতা বেশি হলে গাছের পাতাগুলি হলদেটে ও বেঁটে হয় এবং অনেকসময় গাছগুলি মারা যায়। উচ্চ আর্দ্রতা ও শুকনো পাতা এই ছত্রাক বিস্তারের জন্য উপযুক্ত।
রোগটির প্রতিকার:
ক) রোগাক্রান্ত শুকনো ও পড়ে থাকা পাতাগুলি একত্রিত করে সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে ফেলুন।
খ) ডালিয়ানোভা বা ডালিয়ানোভা হিপনোটিকার মতো প্রতিরোধী জাত রোপণ করুন।
গ) নিন্মলিখিত যে কোনও একটি ছত্রাকনাশক পর্যাক্রমে ১০ থেকে ১৫ দিন অন্তর স্প্রে করুন : হেক্সাকোনাজল ৫ ইসি (২ মিলি প্রতি লিটার জলে) ডাইফেনোকোনাজল ২৫% ইসি (০.৫-১.০ মিলি প্রতি লিটার জলে), ট্রায়াডিমেফন ২৫% ডাব্লুপি (০.৫ গ্রাম প্রতি লিটার জলে), ফেনারিমল ১০% ইসি (০.৪ মিলি প্রতি লিটার জলে) বা কার্বেন্ডাজিম ৫০% ডাব্লুপি (২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে) দিয়ে স্প্রে করুন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.