আনন্দই হোক বা দুঃখের অনুষঙ্গে একদিন -প্রতিদিনে রজনীগন্ধার চাহিদা অফুরান। চাষের অনুকূল পরিবেশ, রপ্তানির পোক্ত ব্যবস্থা থাকায় বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতে রজনীগন্ধা চাষের গুরুত্ব অপরিসীম। লিখছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের গবেষক অয়ন প্রামাণিক। পড়ুন প্রথম পর্ব।
মানব জীবনে ফুলের ব্যবহার আনন্দের, শোক-সন্তাপের অবিচ্ছেদ্য অংশ, প্রবাদ অনুযায়ী জীবনের শুরুতে এমনকি অন্তিম যাত্রাতেও ফুল মানুষের সাথী। এমনই একটি বহুল প্রচলিত ফুল হল রজনীগন্ধা, যার পাঁপড়ির অমলিন ঘন সাদা রং, অপার সৌন্দর্য এবং গভীর সুগন্ধ একে করে তুলেছে পবিত্রতার প্রতীক, তাই শোকপ্রকাশে, শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অথবা বিবাহবন্ধন স্থাপনে সর্বত্রই রজনীগন্ধার ব্যবহার অপরিহার্য। সামাজিক থেকে ধর্মীয় সবরকম আচার অনুষ্ঠানে রজনীগন্ধা ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হয়। তাই, আমাদের দেশে আভ্যন্তরীণ ফুলের বাজারে সর্বাধিক জনপ্রিয় ফুলগুলির মধ্যে অন্যতম হল রজনীগন্ধা। এর জন্মস্থল মেক্সিকো হলেও, ইউরোপীয়ানদের হাত ধরে প্রায় ষোড়শ শতকে ভারতে প্রথম রজনীগন্ধার প্রবেশ ঘটে। এই ফুল সাধারণত সন্ধ্যারাতে ফোটে এবং সুগন্ধ ছড়ায়, তাই ‘রজনীগন্ধা/ নিশিগন্ধা’ নামকরণ। কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে ফুলদানিতে, পুষ্পস্তবকে কিংবা লুস ফ্লাওয়ার (ঝরাফুল) হিসেবে মালা বা মুকুট তৈরিতে রজনীগন্ধার জুড়ি মেলা ভার।
উপরন্তু অত্যন্ত সুগন্ধের অধিকারী হওয়ায় রজনীগন্ধার নির্যাস থেকেও বিবিধ সুগন্ধি, পানীয় তৈরি হয়৷ ভালো মানের রজনীগন্ধার পুষ্পদন্ড (স্টিক) ফুলদানিতে প্রায় ৭-১০ দিন সতেজ থাকতে পারে এবং সুগন্ধে চারপাশ বিমোহিত করে তোলে৷ অফুরান চাহিদা, চাষের অনুকূল পরিবেশ, রপ্তানি ব্যবস্থা থাকায় বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতে রজনীগন্ধা চাষের গুরুত্ব অপরিসীম । কন্দজাতীয় এই ফুল সাধারণত উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়ায় যেকোনো ধরনের মাটিতে জন্মাতে পারে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও রজনীগন্ধার চাষ জনপ্রিয় । এরাজ্যের বাগনান, কোলাঘাট, পাঁশকুড়া, রানাঘাট, কৃষ্ণনগর, প্রভৃতি অঞ্চলগুলি চাষের জন্য বিখ্যাত।
মূলত মার্চ- এপ্রিল মাস কন্দ রোপণের উপযুক্ত হলেও, সারাবছর ব্যাপী চাহিদার জোগান দিতে বর্তমানে এই অঞ্চলগুলিতে সারাবছর জুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির রজনীগন্ধার চাষ হয়। কিন্তু এই বছর অকাল বৃষ্টি এবং বন্যার কারণে আমাদের রাজ্যে বিভিন্ন অংশে বিশেষত পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কোলাঘাট, পাঁশকুড়া এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে এই ফুলের চাষ রোগের কারণে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং চাষিরা প্রভূত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এছাড়াও, রজনীগন্ধার চাষ নানান রোগের কারণে ব্যাহত হয়েছে, উৎপাদিত ফসল রপ্তানিযোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। তাই এই পর্বে রজনীগন্ধার কিছু রোগ এবং সেগুলির আগাম প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
কাণ্ড পচা ও স্ক্লেরোসিয়াম উইল্ট: স্ক্লেরোসিয়াম রল্ফসি (Sclerotium rolfsii) নামক ছত্রাকের কারণে এই রোগ হয়। পশ্চিমবঙ্গে রজনীগন্ধা চাষের ক্ষেত্রে যে কয়েকটি রোগ অন্তরায়, তার মধ্যে কাণ্ড পচা অন্যতম । মৃত্তিকাজনিত এই ছত্রাকটির আক্রমণে মাটিতলের কাছাকাছি কান্ডের ও পাতার অংশে সাদা অনুচক্র জালিকার আস্তরণ দেখা যায় । রোগের প্রকোপ বাড়লে আক্রান্ত জায়গাগুলি ফ্যাকাশে সবুজ বর্ণ ধারণ করে এবং পুরো পাতা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সুস্থ গাছের তুলনায় অনেকখানি হালকা রঙের হওয়ায় আক্রান্ত গাছগুলিকে খুব সহজে চিহ্নিত করা যায়। এরপর ধীরে ধীরে আক্রান্ত পাতাগুলি গাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় | সংক্রমণ বাড়ার সাথে সাথে সমগ্র গাছটি দুর্বল হয়ে যায় এবং অনুৎপাদনশীল হয়ে পড়ে।এই ছত্রাকটিই আবার কিছু সময়ে গাছের শিকড় অংশে আক্রমণ করে।
তখন এই রোগটিকে স্ক্লেরোসিয়াম উইল্ট বলা হয়৷ সেক্ষেত্রে প্রধান উপসর্গ হিসেবে পাতা হলুদ হয়ে প্রথমে ঢলে পড়ে এবং তারপর ঝরে যায়। সংক্রমণের শুরুতে ছত্রাকটি কন্দ এবং কাণ্ডের কলার (Collar) অংশের মাধ্যমে উপরিভাগে ছড়িয়ে পড়ে। কন্দ এবং শিকড় উভয় জায়গাতেই পচা অংশ দেখা যায় এবং মাটির কাছাকাছি পচা কান্ডে এবং পত্রবৃন্তে ছত্রাকের গাঢ় আস্তরণ দেখা যায়। এমনকি কিছুক্ষেত্রে পুষ্পদন্ডগুলিও পচে যায়।
প্রতিকার:
১. উপসর্গ ভিন্ন হলেও যেহেতু রোগটি মৃত্তিকা বাহিত তাই রোগের প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য মাটি শোধন করে কন্দ রোপণ করা উচিত । এর জন্য গ্রীষ্মকালে প্রথমে মাটি গভীরভাবে চাষ দিয়ে কিছুদিন ভালোভাবে রোদ খাওয়াতে হবে ।
২. মাটির আর্দ্রতার পরিমাণ সুষম রাখতে হবে, সেকারণে পরিমিত সেচ প্রয়োগ করতে হবে।গরমের সময়ে সপ্তাহে দুবার এবং শীতকালে ১২-১৩ দিন অন্তর সেচ দেওয়া সমীচীন
৩. কন্দ রোপণের সময়ে উপযুক্ত দূরত্ব বজায় রেখে (৪৫ x ৩৫ সেমি ) রোগের প্রকোপ কমানো যেতে পারে।
৪. জৈব ছত্রাকনাশক যেমন ট্রাইকোডারমা, ব্যাসিলাস সাবটিলিস অথবা সিউডোমোনাস ফ্লুওরেসেন্স ইত্যাদি দ্বারা কন্দশোধন বা মাটিতে জৈবসারের সাথে মিশিয়ে প্রতি বিঘা জমিতে ছড়িয়ে দিতে হবে।সেক্ষেত্রে জমির মাটি তৈরির সময়।
৫. গ্রাম করে ট্রাইকোডারমা ভিরিডি ও সিউডোমোনাস পাউডার ১ কেজি জৈবসারের সাথে মিশিয়ে ১ বর্গমিটারে প্রয়োগ করা যেতে পারে অথবা ৫০০ গ্রাম হারে ট্রাইকোডারমা ভিরিডি বা সিউডোমোনাস ১০০ কেজি জৈবসারের সাথে মিশিয়ে ১ বিঘা মূল জমিতে প্রয়োগ করা যেতে পারে।এছাড়া কন্দ রোপনের আগে সেগুলিকে সিউডোমোনাস ফ্লুওরেসেন্স @ ১০ গ্রাম প্রতি লিটার দ্রবণে কিছুক্ষন (২০-৩০ মিনিট) শোধন করে রোপণ করলে রোগের সম্ভবনা কমে। ৫. রাসায়নিকের ক্ষেত্রে প্রক্লোরাজ ৫.৭% + টেবুকোনাজল ১.৪% ই এস @ ৩ মিলি প্রতি ১০ কেজি কন্দ হিসেবে অথবা ম্যানকোজেব ৭৫% ডব্লু পি @ ৩ গ্রাম অথবা টেবুকোনাজল ৭৫%ডি এস @ ১ মিলি প্রতি ১ কেজি কন্দ হিসেবে মিশিয়ে কন্দশোধন করা যেতে পারে।
বট্রাইটিস ব্লাইট: এই রোগের কারণ হল বট্রাইটিস ইলিপ্টিকা (Botrytis elliptica) নামক ছত্রাক প্রধানত বর্ষাকালে অতিরিক্ত আর্দ্রতায় এই রোগ দেখা যায়। সাধারনত ফুলেই উপসর্গ সীমিত থাকলেও,অধিক সংক্রমণে পাতা বা কান্ডতেও উপসর্গ দেখা দেয়। আক্রান্ত ফুলগুলিতে গাঢ় বাদামি রঙের ছোপ লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীতে গোটা পুষ্পদন্ডটি শুকিয়ে যায়। জমিতে সংক্রমণ শুরু হলে চাষীরা ভীষণভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হন।প্রতিকার:
১. জমিতে হাওয়া চলাচলের পথ সুগম রাখতে হবে।
২. পুষ্পদণ্ড কিংবা পাতার উপর যাতে জল জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং কোনো গাছে সংক্রমণ শুরু হলে সেটিকে তুলে ফেলতে হবে । ৩. সংক্রমণ অধিক হলে কার্বেনডাজিম @ ১ গ্রাম অথবা কার্বেনডাজিম ১২% + ম্যানকোজেব ৬৩% ডব্লু পি @ ২.৫ – ৩ গ্রাম অথবা ক্লোরোথ্যালোনিল ৭৫% ডব্লু পি @ ১-২ গ্রাম অথবা অ্যাজোক্সিস্ট্রবিন ১৮.২% + ডাইফেনোকোনাজল ১১.৪%এস সি @ ০.৫-০.৭ মিলি প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে ৭-১৪ দিন অন্তর হিসেবে ৩-৪ বার প্রয়োগ করে রোগের ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো যেতে পারে।
পাতার আগা পচা বা টিপ ব্লাইট: ফোমা মন্ডৌরিয়েনসিস (Phoma mondouriensis) নামক ছত্রাকের কারণে রোগটি হয় । সাম্প্রতিককালে ২০১৬ সালে নদিয়ার মন্ডোরি থেকে প্রথম রোগটিকে চিহ্নিত করা হয়। এই অঞ্চল ছাড়াও নদিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি,বীরভূম, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বেশ কিছু অংশে টিপ ব্লাইটের হদিশ পাওয়া গেছে । প্রথমে আক্রান্ত পাতার একদম অগ্রভাগে বাদামি ছোপ এক বা উভয়প্রান্ত থেকে পরিলক্ষিত হয়। পরে উপযুক্ত আবহাওয়ায় উভয় প্রান্তের ছোপ মিশে গিয়ে বড় আকার ধারণ করে এবং ক্রমশ পাতার অগ্রভাগ থেকে নিচের দিকে অগ্রসর হয়। এই পর্যায়ে আক্রান্ত অংশের রঙ ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে ধুসর কিংবা খড়ের মতো হলুদ বর্ণ ধারণ করে। এভাবে সমগ্র পাতাটি ধীরে ধীরে শুকিয়ে মারা যায়৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.