শিকড় ফোলা (ক্লাবরুট) রোগটি সরষে জাতীয় ফসলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৃত্তিকা বাহিত রোগ। ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকোলি, সরষে, রাই এই সমস্ত ফসলে এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। সঠিক পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে ও সুসমন্বিত প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই রোগের প্রতিকার করা সম্ভব। লিখেছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজু দাস ও স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষের ছাত্র দেবাদিত্য চট্টোপাধ্যায়।
ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলে একই জমির ফসল নিবিড়তা বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। ফলে সব ধরণের বাস্তুতন্ত্রে মৃত্তিকা বাহিত রোগ জীবাণুর বাড়বাড়ন্ত বেশ লক্ষণীয়। ফসলের যেসব রোগের জীবাণু মাটিতে বা মাটির মধ্যে রয়ে যাওয়া পচনশীল অবশিষ্টর মধ্যে বেঁচে থাকতে পারে সেইসব রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে মৃত্তিকা বাহিত জীবাণু বলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা মাটির নীচে সংক্রমণ করলেও অনেকটা সময় অবধি দৃষ্টিগোচর হয় না। মাটির উপরের অংশে যখন রোগ লক্ষণ প্রকাশ পায় তখন সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও অর্থনৈতিক ভাবে খুব একটা লাভ হয় না।
মাটিবাহিত রোগ জীবাণুগুলি মাটির মধ্যে থাকা ফসলের অবশিষ্টাংশের মধ্যে থেকে দীর্ঘকাল অবধি বেঁচে থাকে এবং নতুন ফসলে সংক্রমণ ঘটায়। মৃত্তিকা বাহিত রোগ জীবাণুকে রাসায়নিক কৃষিবিষ দিয়ে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে দেখা গেছে তা বাণিজ্যিক ভাবে অলাভজনক এবং মাটিতে বসবাসকারী উপকারী জীবাণুর সংখ্যা কমিয়ে মাটির অণুজীব বৈচিত্র্য নষ্ট করে এবং মৃত্তিকাবাহিত রোগ জীবাণুর মধ্যে কৃষিবিষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। শিকড় ফোলা (ক্লাবরুট) রোগটি সর্ষে জাতীয় ফসলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৃত্তিকা বাহিত রোগ।
ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকোলি, সর্ষে, রাই এই সমস্ত ফসলে এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। ত্রয়োদশ শতকের দিকে এই রোগটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। উনিশ শতকে সেন্ট পিটার্সবার্গে এই রোগটি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে এবং মহামারীর আকার নেয়। ১৮৭৫ সালে প্রথম এই রোগের জীবাণুটি চিহ্নিত করেন মিখাইল ওরোনিন। ১৮৭৭ সালে তিনি এই জীবাণুটিকে বর্ণিত করেন। এই রোগটিকে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলায় ১৯৫২ সালে প্রথম লক্ষ্য করা গিয়েছিল।এই রোগের কারণে ফসলের ফলন উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যায়। এই রোগের তীব্রতার তারতম্যের উপর নির্ভর করে ফসলের ফলন প্রায় ১০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ অবধি কমে যায়। যদি শিকড়ে এই রোগের সংক্রমণ ৩০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ অবধি হয় তবে উৎপাদন প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এই রোগের জীবাণুটিকে আদ্যপ্রাণী বলা হয়। এটি বাধ্যতামূলক পরজীবী অর্থাৎ পোষক দেহের বাইরে এরা বেঁচে থাকতে পারে না। প্লাসমোডিওফোরেসি গোষ্ঠীভুক্ত এই জীবাণুটির নাম প্লাসমোডিওফোরা ব্রাসিকি।
রোগের লক্ষণ
এই রোগের ক্ষেত্রে গাছটি আক্রান্ত হওয়ার বেশ কিছু দিন পর রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। আক্রান্ত গাছের আকার কিছুটা ছোট হয়ে যায় এবং পাতাগুলো ফিকে হলদেটে রঙ ধারণ করে। আক্রান্ত গাছের প্রধান মূলের উপর ফোলা, গদাকৃতি গুচ্ছ তৈরি হয়। এই ঘটনায় গাছের মূল স্বাভাবিক ভাবে মাটি থেকে জল শোষণ করতে পারে না, ফলত গাছে ঝিমিয়ে পড়া সম্পর্কিত উপসর্গ গুলি দেখা যায়। স্বাভাবিক আকৃতি হারিয়ে গাছের শিকড়গুলি বিকৃত হয় এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে মাটিতে থাকা অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। গুচ্ছগুলি কেবলমাত্র প্রধান মূলে অথবা কেবল মাত্র পার্শ্বমূলে অথবা দুই ধরনের মূলেই হতে পারে।
রোগচক্র
জীবাণুটির জীবনচক্র শুরু হয় সুপ্ত রেণুর মাধ্যমে। এই রেণু গুলি মৃত্তিকাতে প্রায় কুড়ি বছরের বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারে। এই রেণু গুলির বাইরের আবরণে কায়টিন থাকে। রেণুগুলির ব্যস ৪ মিলিমিটার অবধি হয়ে থাকে। প্রতিটি রেণুর দুটি করে ফ্ল্যাজেলা থাকে যাদের সাহায্যে এরা চলমান হয়। এই চলরেণুগুলি সাঁতার কেটে মাটির জলীয় অংশের মধ্য দিয়ে কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করার পর মূলরোম বা ক্ষতর সংস্পর্শে আসে এবং পোষকের দেহে প্রবেশ করে। সুপ্ত রেণুগুলি মাটির মধ্যে প্রায় ২০ বছর অবধি বেঁচে থাকে। মূল থেকে যেসব রাসায়নিক পদার্থ বের হয় তাদের সংস্পর্শে এসে এই রেণুগুলির অঙ্কুরোদম হয়। পোষকের মধ্যে যাওয়ার পর এরা অ্যামিবার মতো কোষ তৈরি করে। এই কোষগুলির বংশবৃদ্ধি হয় এবং প্লাসমোডিয়াম তৈরি হয়। এই প্লাসমোডিয়াম গুলির অসংখ্য বিভাজন হয়, আরও অসংখ্য চলমান রেণু তৈরি হয়। এই রেণুগুলি মাটিতে গিয়ে পূনরায় নতুন পোষককে আক্রমণ করে।
বিস্তার
আক্রান্ত জমির চারার মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়। রোগের বিস্তারে তাপমাত্রার ও মাটির আর্দ্রতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। মাটির তাপমাত্রা সাধারণত ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে এই রোগের আক্রমণ বেশি লক্ষ্য করা যায়। রোগের আক্রমণ সবথেকে বেশি হয় ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। মাটির অম্লমাত্রা ৫.২ থেকে ৬.৬ হলে রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। তবে মাটির অম্লমাত্রা নিরপেক্ষ থেকে ক্ষারীয় হলে রোগের আক্রমণ কম হয়। রোগের জীবাণুটি সেচের জল, কৃষি যন্ত্রপাতি, গবাদি পশুর চলাচল, বাতাসে বাহিত মৃত্তিকার মাধ্যমে বাহিত হয়। সব ধরনের মাটিতে যেমন হালকা মাটি, বেলে মাটি, হিউমাস মৃত্তিকাতে সংক্রমণ বেশি হয়। মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে এই জীবাণুর প্রভাব কমতে থাকে। মাটিতে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ আর্দ্রতা এই রোগের অনুকূল। মাটিতে উপস্থিত সুপ্ত রেণু ও তার
সংখ্যার আধিক্যের উপর এই রোগের তীব্রতা নির্ভর করে।
প্রতিকার
বেশ কয়েক বছরের জন্য (৭ থেকে ৮ বছর) শস্য আবর্তনে সর্ষে জাতীয় ফসল চাষ না করলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব কম হয়।শ্বেত সর্ষে এই রোগের প্রতি খুবই সংবেদনশীল। আবার গোবি সর্ষের প্রতিরোধী জাত কল্যাণ চাষ করলে এই রোগের আক্রমণ কম হয়।উন্নত জল নিকাশি ব্যবস্থার মাধ্যমে জমি থেকে যতটা সম্ভব জল বের করে দেওয়া দরকার। কারণ মৃত্তিকায় জল থাকলে তা চলরেণুর গমনে সাহায্য করে। একই সাথে জমির জল অন্য ক্ষেতে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে এবং প্রয়োজন পড়লে জমিতে সেচ বন্ধ রাখতে হবে।ফসল বোনার ১ মাস আগে প্রতি হেক্টর জমিতে ৩ টন চুন প্রযোগ করতে হবে এবং মাটির অম্লত্ব-ক্ষারত্ব মাত্রা ৭.২ থেকে ৭.৪ এ নিয়ে যেতে হবে।প্রতি হেক্টর জমিতে ১.৫ টন হারে নিম খোল ও মহুয়া খোল ১:১ অনুপাতে প্রয়োগ করতে হবে যাতে রোগের তীব্রতা কমানো যায়। সিউডোমোনাস ফ্লুরেসেন্স ও ব্যাসিলাস সাবটিলিসকে সঠিক পরিমাণে (পাঁচ থেকে ছয় কেজি) একশো কেজি জৈব সারের সাথে মিশিয়ে মূল জমিতে প্রযোগ করতে হবে। মাটিতে বোরোন ধারণকারী রাসায়নিক গুলিকে ৪ কেজি প্রতি হেক্টর প্রয়োগ করতে হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.