মুগ সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, খনিজ পদার্থ, ফাইবারে সমৃদ্ধ। রাজ্যের প্রায় সব জেলাতেই মুগের চাষ হয়ে থাকে। উন্নত প্রযুক্তিতে এবং উন্নত জাতের মুগ চাষ করে হেক্টর প্রতি ১০ কুইন্টালেরও বেশি ডাল উৎপাদন করা যায়। এই মুগ চাষ করে কৃষকের প্রভূত আয়ের সম্ভাবনা। লিখেছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শস্য বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক ওসমান আলি।
মুগ একটি স্বল্পমেয়াদী শিম্বগোত্রীয় ডালশস্য। মুগের ডাল অতিশয় পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। এতে প্রায় ২৫-২৮ শতাংশ প্রোটিন আছে। প্রোটিন ছাড়াও ১-১.৫ শতাংশ স্নেহপদার্থ, ৪.৫–৫.৫ শতাংশ খনিজ পদার্থ, ৩.৫–৪.৫ শতাংশ ফাইবার এবং ৬২-৬৫ শতাংশ শর্করা থাকে। মুগ পশ্চিমবঙ্গের একটি জনপ্রিয় ডালশস্য। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব জেলাতেই কমবেশি মুগের চাষ হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে প্রায় ৫৭ হাজার হেক্টর জমিতে মুগ চাষ করা হয়। মোট উৎপাদন ৪৮ হাজার টন এবং প্রতি ৮২৪ কেজি মুগ উৎপাদন করা হয়। উন্নত কৃষি প্রযুক্তি এবং সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত উন্নত জাতের ব্যবহারের মাধ্যমে হেক্টর প্রতি ১২-১৫ কুইন্টাল ফলন পাওয়া সম্ভব।
জমি নির্বাচন:
প্রায় সব মাটিতেই মুগ চাষ হয়। তবে জলাজমিতে এই শস্যের চাষ একেবারেই ভাল হয় না। তাই জল নিকাশের সুবিধাযুক্ত দোআঁশ বা বেলেমাটি মুগ চাষের উপযুক্ত। মুগ কিছুটা খরা সহ্য করতে পারে।
বোনার সময়:
গ্রীষ্মকালীন বা চৈতি মুগ বোনার উপযুক্ত সময় হল ফাল্গুণের মাঝামাঝি থেকে চৈত্রের মাঝামাঝি । গ্রীষ্মকালীন চাষে ফলন বেশি পাওয়া যায়। খরিফ বা বর্ষাকালীন মুগ বোনার আদর্শ সময় হল শ্রাবণের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ভাদ্রের মাঝামাঝি (আগস্ট মাস)।
বীজের হার:
ভাল ফলন পেতে সঠিক পরিমাণে বীজ বোনা খুব জরুরি। বিঘা প্রতি সাধারণত ৪–৫ কেজি বীজ লাগে। তবে জাত অনুসারে বীজের পরিমাণ কমবেশি হতে পারে।
বীজ শোধন:
বোনার প্রায় এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি বীজের জন্য কার্বেন্ডাজিম ও থাইরামের ১:২ অনুপাত মিশ্রণ ৩ গ্রাম মিশিয়ে শোধন করে নিতে হবে।
জীবাণু সার:
রাইজোবিয়াম লেগুমিনোসিরাম প্রতি বিঘা চাষের জন্য যতটা বীজ প্রয়োজন তার সঙ্গে ২০০ গ্রাম জীবাণু সার জলের সাথে মিশিয়ে লেই তৈরি করে বীজের গায়ে মাখাতে হবে।
বোনার পদ্ধতি:
সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেমি। গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১০ সেমি। প্রতি বর্গমিটারে ৫০-৫৫টির বেশি গাছ রাখা উচিত নয়। বীজ সব সময় সারিতে বোনা উচিত। ছিটিয়ে বুনলে অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা করতে অসুবিধা হয়। এছাড়া রোগ পোকার উপদ্রবও বেশি হয়।
সার প্রয়োগ:
মুগ চাষে সারের পরিমাণ অন্যান্য ফসলের তুলনায় সাধারণত কম পরিমাণে লাগে। জমি তৈরির সময় মূল সার হিসাবে হেক্টর প্রতি যথাক্রমে ২০, ৪০ ও ২০ কেজি নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ যথাক্রমে ইউরিয়া, সিঙ্গল সুপার ফসফেট ও মিউরিয়েট অফ পটাশের মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে অনুখাদ্যের অভাব হলে বোনার ২৫-৩০ দিনের মাথায় ফুল আসার আগে ০.২ শতাংশ বোরাক্স দ্রবণের সঙ্গে ০.০৫ শতাংশ অ্যামোনিয়াম মলিবডেট দ্রবণ মিশিয়ে পাতায় স্প্রে করলে বোরন ও মলিবডেট ঘাটতি মেটানো হয়।
অন্তর্বর্তী পরিচর্যা:
সারিতে বোনার ক্ষেত্রে ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে সবল গাছগুলি রেখে দুর্বল ও বাড়তি চারাগুলিকে তুলে ফেলতে হবে। বোনার ২০ ও ৩৫ দিনের মাথায় নিড়ানির সাহায্যে আগাছা পরিষ্কার আবশ্যক। প্রথম নিড়ানির সময় সবল গাছগুলি নির্দিষ্ট দূরত্বে রেখে বাকি গাছগুলি পাতলা করে দিতে হবে।
জলসেচ:
জমিতে রস না থাকলে একটি হালকা সেচ দিয়ে বীজ বোনা দরকার। সাধারণত আর কোনও সেচ লাগে না। তবে ফুল আসার সময়ে আর একবার সেচ দিলে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
মুগের রোগ
ক) হলদে নকশা রোগ বা কুটে রোগ: এটি একটি ভাইরাস ঘটিত রোগ। এর বাহক পোকা সাদা মাছি। সাধারণত বীজ লাগানোর ২০-২৫ দিন পরে এই রোগের সংক্রমণ ঘটে। অত্যধিক আক্রমণে গাছের পাতাগুলির শিরা হলুদ হয়ে যায় ও গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। সাদা মাছি দমনের মাধ্যমে এই রোগটির আক্রমণ কমানো যায়। প্রথম দিকে একটি গাছে আক্রমণ দেখামাত্র আক্রান্ত গাছগুলি তুলে পুড়িয়ে ফেলা উচিত। আক্রমণ বাড়লে ইমিডাক্লোরপ্রিড ১৭.৮ শতাংশ এস.ষএস (০.২ মিলি/লিটার জলে) অথবা অ্যাসিফেট ৭৫ শতাংশ ডাব্লুপি (০.৭৫ গ্রাম / লিটার জলে)।
খ) সাদা গুঁড়ো রোগ: এই রোগ ছত্রাকঘটিত। এই রোগে গাছের নীচের দিকে পাতার উপর সাদা গুঁড়ো বা পাউডার দেখা যায়। মাইকোবুটানিল ১০ ডাব্লুপি (০.০৫ গ্রাম/লিটার জলে) অথবা টাইডেমরফ ৮০ ইসি (০.৫ গ্রাম/লিটার জলে) স্প্রে করে রোগটির আক্রমণ কমানো যায়।
মুগের পোকা
ক) শুঁটি ছিদ্রকারী পোকা: এই পোকা দমনের জন্য ইণ্ডোক্সিকার্ব ১৪.৫৫ এসসি (০.৫ মিলি/লিটার) জলে গুলে স্প্রে করতে হবে অথবা অ্যাসিফেট + ইমিডাক্লোপ্রিড (৫০% + ৩) এসপি (১ গ্রাম/লিটার) জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
খ) জাব পোকা:
এই পোকার জন্য অক্সিডিমেটন মিথাইল প্রয়োগ করতে হবে।
ফসল তোলা:
বেশি ফলন পেতে গেলে দুই থেকে তিনবার পাকাশুঁটি তোলা দরকার। বীজ বোনার ৫০-৬০ দিনের মধ্যে মুগের শুঁটি পাকতে শুরু করে। তখন শুঁটি তুলে নিতে হয়। ভাল জাত ব্যবহার করলে ৮০% শুঁটি একই সঙ্গে পেকে যায়। ফলে ফসল তোলার সুবিধা হয়।
ফলন:
সঠিক ভাবে চাষ করলে বিঘা প্রতি ১৩০ কেজি ফলন পাওয়া যায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.