শিশিরভেজা সকাল আর শিউলি ফুলের সুগন্ধময় শীতল বাতাস জানিয়ে দেয় শরৎ এসে গিয়েছে। এই ফুল ও গাছের হরেক গুণ রয়েছে। শিউলি ফুল হলুদ রং তৈরি করতে ব্যবহার করা যায়। শিউলি গাছের পাতা নানা যন্ত্রণাদায়ক সমস্যার চিকিৎসার জন্যে ঔষধ বা বড়ির মতো করে আয়ুর্বেদিক ঔষধ তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়। এর পাতায় থাকে ডি-মানিটল, ফ্লাভানোল গ্লুকোসাইডেজ এর মতো কেমিক্যাল কম্পাউন্ড। মাথার খুসকি দূর করতে শিউলি বীজ ব্যবহার করা হয়। শিউলির সাতকাহন লিখেছেন ব্রেনওয়ার ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ এগ্রিকালচারের সহকারী অধ্যাপক ড. সৌরভ রায়।
“শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ঐ। এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথি কই…।” বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম শরৎকালে বিরহ ব্যথায় কাতর হয়ে এভাবেই শিউলি ফুলের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। শুধু তিনি নন, বাংলা সাহিত্যে শরৎকালের অনুষঙ্গ যত বার এসেছে, সাহিত্যিকরা তাঁদের কলমে শিউলি ফুলকে টেনে এনেছেন ততবারই। শরৎ আর শিউলি ফুল যেন একে অপরের দোসর। নাগরিক জীবন যখন স্যাঁতসেঁতে বর্ষা থেকে মুক্তি লাভের আশায় প্রতিক্ষারত থাকে, ঠিক তখনই শরৎ আসার খবর জানান দিয়ে যায় মাটির বুকে শিউলির বিছানা।শরতের শিশিরভেজা সকাল আর শিউলি ফুলের সুগন্ধময় হাতছানি – এই দুই মিলিয়ে আমরা যেন এক অনবদ্য মুহূর্তের সাক্ষী থাকি এই সময়। শারদোৎসব আর শিউলি ফুলের সম্পর্কও অনেকটা গভীর, তাই তো দুর্গা পুজোর আগমনী ফুলের মর্যাদা দেওয়া হয় একে। পশ্চিমবঙ্গের “রাজ্য ফুল” বা “স্টেট ফ্লাওয়ার” এর তকমা রয়েছে শিউলি ফুলের।শিউলি গাছ আসলে একধরনের গুল্ম বা shrub।
এই গাছের কাণ্ড নরম ধূসর বাকল দ্বারা বেষ্টিত থাকে এবং এই গাছ সর্বাধিক ১০ মিটারের মতো লম্বা হতে পারে। এই গাছের ‘সেন্টার অফ অরিজিন’ হল দক্ষিণ এশিয়া। কারণ মূলত এই অঞ্চলেই এই গাছের আধিক্য সর্বাধিক চোখে পড়ে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব থাইল্যান্ড থেকে বাংলাদেশ, ভারত, উত্তরে নেপাল ও পাকিস্তান পর্যন্ত এলাকা জুড়ে দেখতে পাওয়া যায়। ইন্দো-চিন, হিমালয় এবং জাভা-সুমাত্রা অঞ্চলের শুষ্ক পর্ণমোচী বন এবং পাহাড়ের ধারে এর আদি নিবাস। ত্রিপুরার আদিবাসীরা আবহাওয়া এবং বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস জানার জন্য উদ্ভিদটি ব্যবহার করে।শিউলি গাছের পাতা ৬-৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে ও সমান্তরাল প্রান্তের বিপরীতমুখী থাকে। সুগন্ধি এই ফুলে থাকে পাঁচ থেকে সাতটি সাদা বৃত্তি ও মাঝে লালচে-কমলা টিউবের মত বৃন্ত। ফুল গুলো এক থোকায় বা ক্লাস্টারে ফুটে ওঠে।
ফল দুই সেন্টিমিটার বা ০.৭৯ ইঞ্চি ব্যাসের গোলাকার ক্যাপসুল থেকে চ্যাপ্টা বাদামী হৃৎপিণ্ডের আকৃতির হয়ে থাকে এবং দুটি ভাগে বিভক্ত থাকে। প্রতিটি লোবে একটি করে বীজ থাকে।শিউলি ফুল এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Nyctanthes arbor-tristis. ল্যাটিন ভাষায় genus Nyctanthes কথাটির মানে হল “সন্ধ্যায় ফোটা” এবং species arbor-tristis-এর মানে হচ্ছে ‘বিষণ্ণ গাছ’। সন্ধ্যায় বা প্রদোষকালে ফোটা আর ঊষাকালে ঝরে যাওয়া ফুলের মাঝে শিউলি গাছ যেন স্থায়ী ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে এক অদ্ভুত বিষন্নতায়, তাই শিউলি গাছের এহেন নামকরণ করা হয়েছে। শিউলিকে কখনও কখনও “tree of sorrow” বা “tree of sadness” বা “দুঃখের বৃক্ষ”-ও বলা হয় কারণ দিনের আলো বাড়ার সাথে সাথে এই ফুলের নিজস্ব দীপ্তি ও ঔজ্জ্বল্য হ্রাস পায়।হিন্দু শাস্ত্র মতে শিউলির ফুলের আরেক নাম পারিজাত !
বলা বাহুল্য, হিন্দুদের পুজোয় একমাত্র শিউলিই এমন ফুল যেটি মাটিতে ঝরে পড়লেও তাকে দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়ে থাকে।পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, সমুদ্র মন্থন থেকে পারিজাত (Parijat Flower) বা শিউলি গাছের উদ্ভব হয়। আর সেই সমুদ্র মন্থন থেকেই মা লক্ষ্মীও আবির্ভূতা হন। ধনদেবী লক্ষ্মীর এই শিউলি গাছ খুবই প্রিয়। তাই মা লক্ষ্মীর পুজোয় পদ্ম ফুলের পাশাপাশি শিউলি ফুলও অর্পণ করা হয়। ইন্দ্র স্বর্গে পারিজাতের অলৌকিক বৃক্ষ রোপণ করেছিলেন। বাস্তু শাস্ত্ৰ অনুযায়ী তাই এই গাছ দীর্ঘায়ু দেয় বলে বিশ্বাস। এছাড়া এই গাছ গৃহে প্রচুর ধনসম্পদও আনে। পারিজাত গাছ ঘরে লাগালে মানসিক চাপ দূর হয় এবং গৃহশান্তি বজায় থাকে।শিউলি ফুল হলুদ রঙ তৈরি করতে ব্যবহার করা যায়। এই ফুলের বোঁটা গুলো শুকিয়ে গুঁড়ো করে পাউডার করে হালকা গরম জলে মেশালে চমৎকার রঙ উৎপন্ন হয়।
শিউলি গাছের পাতা sciatica, arthritis, fevers, নানারকম যন্ত্রণাদায়ক সমস্যার চিকিৎসার জন্যে ঔষধ বা বড়ির মত করে আয়ুর্বেদিক ঔষধ তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়। এর পাতায় থাকে ডি-মানিটল, ফ্লাভানোল গ্লুকোসাইডেজ এর মত কেমিক্যাল কম্পাউন্ড। মাথার খুসকি দূর করতে শিউলি বীজ ব্যবহার করা হয়।নগরকেন্দ্রিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত আধুনিক সমাজের কাছে তাদের পছন্দের বাগান করার জন্যে ছাদ বা বারান্দাই একমাত্র সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ জনবিস্ফোরণ, শিল্পায়ন ও নগরায়নের এই যুগে মাথাপিছু জমির পরিমাণ সঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে তাই টবে শিউলি গাছ লাগানোর প্রচলন জনপ্রিয় হচ্ছে। কারণ প্রয়োজনীয় পরিচর্যা নিলে গাছ লাগানোর এক-দেড় বছর পরে ফুল আসতে শুরু করে, তবে তা পরিমাণে অল্প। তিন-চার বছর পরে ফুল হয় ব্যাপক হারে।শিউলি ফুল অগস্টের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে, প্রায় মধ্য জানুয়ারি অবধি ফোটে। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ফুল হয়। কোনও কোনও গাছে আবার সারা বছরই ফুল হয়।
শিউলি লাগানোর উপযুক্ত সময় এপ্রিল। বীজ থেকে চারা তৈরি করে বা নার্সারি থেকে গুটিকলমের গাছ এনে, দু’ভাবেই টবে গাছ করা যায়। তবে টবের জন্য কলমের গাছই উপযোগী। এতে গাছের বৃদ্ধি ও ফুল দুই দ্রুত হয়। কলমের গাছ লাগালে সেই গাছে মাতৃ গাছের সমস্ত চারিত্রিক গুণাবলী বিদ্যমান থাকে। টবের জন্যে গাছের উচ্চতাও সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে কলমের চারা লাগালে।শিউলি গাছের মূল খুব দ্রুত বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়, আর সেই কারণেই শিউলি গাছ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ম করে টব পরিবর্তন করা বাধ্যতামূলক। নার্সারি থেকে কিনে আনা কলমের গাছ প্রথমে ৪-৬ ইঞ্চির টবে বসাতে হবে। তারপর নিয়মিত গাছের বৃদ্ধির দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং গাছকে ৮ ইঞ্চির টবে স্থানান্তরিত করা জরুরি।
গাছের মূল শক্ত হয়ে গেলে এবং গাছে ফুল চলে আসার সাথে সাথে পুনরায় একে ১২ ইঞ্চির টবে স্থানান্তরিত করলে গাছের আয়ু বাড়ে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে স্থানান্তরের প্রতিটি পর্যায়ে গাছের মূলের যাতে ক্ষতি সাধন না হয়, সে ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে হবে। গাছের গোড়া থেকে যখনই শিকড় বের হবে, তখনই সাথে সাথে তার পর্যায়ক্রমিক অপসারণ অত্যন্ত আবশ্যিক।গাছের গোড়ায় জমে থাকা জল গাছের বৃদ্ধির সহায়ক নয় এবং গোড়ায় জল জমলে গাছের মৃত্যু অবধি হতে পারে কারণ, শিউলি গাছ water stagnation সহ্য করতে পারে না তাই টবের ড্রেনেজ সিস্টেম বা জল নিকাশি ব্যবস্থার দিকে নজর রাখতে হবে। এর জন্য গাছ বসানোর আগে টবের ফুটোগুলো প্রথমে খোলামকুচি দিয়ে ঢেকে দিয়ে কিছুটা ইটের টুকরো বা নুড়িপাথর বা স্টোনচিপস দিতে হবে। তাঁর উপর কিছুটা বালি দিয়ে টুকরোগুলো ঢেকে দিতে হবে। বালির স্তরের উপর মাটি দিয়ে গাছ বসাতে হবে।
বালি থাকার জন্য মাটি, বালি ভেদ করে নীচে যেতে পারবে না, ফলে জল আটকাবে না। টবে মাটি দেওয়ার আগে, সাধারণ বাগানের মাটির সঙ্গে গোবর সার, হাড়গুঁড়ো, শিংয়ের কুচি, কিছুটা পুরনো সরষের খোল ভাল করে মিশিয়ে মাটি তৈরি করে নিতে হয়। গাছ বসানোর যেমন একটা নিয়ম আছে, তেমনই পুরনো টব থেকে গাছ বার করারও একটা নিয়ম আছে। গাছ বার করার সময় এক হাত দিয়ে টব উল্টো করে ধরতে হবে, টবের মাটি যেন শুকনো থাকে। অন্য হাত থাকবে গাছের গোড়ায়। উল্টোনো টব ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে সাবধানে শক্ত কোনও উঁচু জিনিসে ঠুকতে হবে। অল্প ঠুকতেই মাটিসুদ্ধ গাছ টব থেকে আলাদা হয়ে যায়। নতুন টবে গাছ বসিয়ে চারপাশে ভাল ভাবে চেপে চেপে মাটি দিলে হাওয়া ঢুকে ক্ষতিকর ছত্রাক ঘটিত রোগ তৈরি হওয়ার ভয় থাকে না। গাছ বসানোর পরপরই পর্যাপ্ত পরিমাণে জল দেওয়া জরুরি। যেহেতু অগস্টের মাঝামাঝি সময় থেকে ফুল ধরে তাই গ্রীষ্মের (এপ্রিল-মে মাস) শুরুতে এক-দেড় ইঞ্চি করে গাছের মাথা ছেঁটে দিলে বা প্রুনিং করলে ফুলের প্রাচুর্যতা যেমন পরিলক্ষিত হয়, ঠিক তেমনি গাছ একটা সুন্দর ঝোপের মত আকৃতি লাভ করে, যা কিনা গাছের শোভা বর্ধন করে।
মরশুমের ফুল শেষ হয়ে গেলে অবশিষ্ট মঞ্জরী ও ছেটে দেওয়া হয়।গাছের বয়স যখন কম থাকে, সেই সময় মাসে একবার তিন-চার দিনের পুরনো খোল (সরষে) পচা জল সার হিসেবে দিতে পারলে তা গাছের বৃদ্ধির সহায়ক হয়। সার দেওয়ার আগের দিন গাছে জল না দিলে, মাটি শুকনো থাকায় শিকড় দ্রুত সার শুষে নিতে পারে। গাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য ১০:২৬:২৬ অনুপাতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম দেওয়া যেতে পারে। তবে গাছের আয়ু বাড়ানোর জন্য রাসায়নিক সারের চেয়ে জৈব সারের ব্যবহার করা শ্রেয়। একটি চার-পাঁচ বছরের গাছের ক্ষেত্রে বছরে দু’বার, ফুল ফোটার আগে এবং মার্চ মাসের শুরুতে নতুন পাতা গজানোর সময়ে সরষের খোল ও গোবর সারের সঙ্গে দু’চামচ হাড়গুঁড়ো মিশিয়ে দিলেই যথেষ্ট। শিউলি গাছে বেশ পোকামাকড় হয়। বিশেষ করে শুঁয়োপোকা বা catterpillar, যা গাছের পাতা খেয়ে ফেলে। সাধারণ পোকামাকড়ের জন্য কয়েক দিন পরপর নিমতেল বা নিম পাতা সিদ্ধ জল ঠান্ডা করে গাছের উপর স্প্রে করে নিলেই হবে। কিন্তু এতে শুঁয়োপোকা যাবে না।
রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করে, এদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সবচেয়ে সহজ উপায় হল, যে পাতার তলায় প্রজাপতি ডিম পাড়বে সেটা ছিঁড়ে দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে ফেলে দেওয়া।আগস্ট মাস থেকে শুরু করে শীত শুরুর আগ অবধি শিউলি ফুল ফুটতে থাকে, বাজারে বিক্রির জন্যে সন্ধ্যার প্রাক্কালে ফুটে থাকা ফুলগুলো সংগ্রহ করে কলাপাতার মোড়কে স্থানীয় বাজারে পাঠানো হয়। শিউলি ফুলের পাপড়ি হতে সুগন্ধি তেল নিষ্কাশন করে বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রীতে ব্যবহার করা হয়। ফুলের পাপড়ি থেকে বান তেল নিষ্কাশনের জন্যে সদ্য ফোটা ফুল পাঠানো হয় নিকটবর্তী কোনও perfumery industry বা প্রসাধনী প্রস্তুতকারক সংস্থায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.