রঞ্জন মহাপাত্র, কাঁথি: বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষে মূলধনের একটি বড় অংশ খরচ হয় খাবার ও রোগ নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধে। গ্রামের বহু পুকুর ফি-বছর সংস্কার করা হয় না। অর্থাভাব ও শরিকি সমস্যায় অনেক সময় পুকুর শুকনো বা জল বদলের সুযোগও থাকে না। এই সব সমস্যা সমাধানে বর্তমানে বাজারে এসেছে বায়োফ্লক প্রযুক্তি (বিএফটি)।
বায়োফ্লক প্রযুক্তি কী? এ সম্পর্কে পূর্ব মেদুিনীপুরের হলিদায় ব্লকের মৎস্য সম্প্রসারণ আধিকারিক সুমন কুমার সাহু জানান, এই প্রযুক্তি জলজ কৃষি পালনের একটি টেকসই এবং পরিবেশগতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ পদ্ধতি যা জলের গুণমাণ এবং ক্ষতিকারক রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুু নিয়ন্ত্রণ করে ও জলীয় খামার ব্যবস্থার জন্য মাইক্রোবায়াল প্রোটিন খাদ্য হিসেবে সরবরাহ করে। গ্রামীণ চলতি কথায়, একে জৈব জুসও বলা হয়ে থাকে। তাই এক কথায়, বায়োফ্লক হল ব্যাকটেরিয়া, জীবিত এবং মৃত বস্তুগত জৈবপদার্থ প্রভৃতি অনুজীবের সমষ্টি। খাদ্য রূপান্তর উন্নত করে খরচ কমিয়ে এবং সঙ্গে একটি পুষ্টিকর খাদ্য উৎস সরবরাহ করা। নোনা জলের বাগদা বা ভেনামী চাষে এর ভূমিকা অন্যতম। বায়োফ্লক প্রযুক্তি মূলত বর্জ্য পুষ্টির পুনর্ব্যবহারযোগ্য নীতি, বিশেষ করে নাইট্রোজেন, মাইক্রোবায়াল জৈববস্তুপুঞ্জের মধ্যে খাবারের খরচ কমাতে এবং মাছের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ‘বায়োফ্লক’ প্রযুক্তি যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে বলে সুমনবাবু আশাপ্রকাশ করেন। তিনি আরও জানান, এই প্রযুক্তির প্রয়োগে পুকুরের জলকে দূষণের হাত থেকে ঠেকানো যায়। ফলে জলে অ্যামোনিয়ার মাত্রা বাড়বে না ও চিংড়ি মারা যাওয়ার আশঙ্কাও থাকবে না। এতে বিভিন্ন ছোট-বড় মাছ-সহ চিংড়ির প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ওষুধ প্রয়োগ করে খরচও করতে হবে না। তাই বায়োফ্লক উপকারি ব্যাকটেরিয়া, অনুজীব অশৈবালের সমন্বয়ে তৈরি হয়ে পাতলা আবরণ, যা জলকে ফিল্টার করে। সরাসরি পুকুরে বায়োফ্লক তৈরি করা যায়। আবার আলাদা পাত্রে তা তৈরি করে পুকুরে ফেলা যেতে পারে। কার্বন থেকে নাইট্রোজেন অনুপাতের সাহায্যে নতুন ব্যাকটেরিয়া কোষ জৈববস্তুপুঞ্জের অ্যাসিডিলেশনের মাধ্যমে বিষাক্ত নাইট্রোজেন যৌগ অপসারণের প্রধান পথ হিসেবে ব্যবহার করে। খাবারের প্রোটিনের উপর নির্ভর করবে কত পরিমাণ কার্বন মেশাতে হবে। সেই অনুযায়ী মোলাসেস বা সুগার বা ভুট্টার আটা বা গমের আটা দিতে হয়। এটার একটা অনুপাত আছে।
বায়োফ্লকের প্রয়োগ কীরকম? ব্যবহারিক চাষের পর্যায়ে দেখা গিয়েছে, হাজার বর্গ মিটার একটি জলাশয়ে আড়াই কেজি বাদাম খোল, তিন কেজি চালের গুঁড়ো, পাঁচশো গ্রাম ইস্ট পাউডার, তিন কেজি চিটে গুড়, দেড় কেজি আটা, তিনশো গ্রাম কলার সঙ্গে যে কোনও পোনা মাছের খাবার দুই কেজি মিশিয়ে ৪৮-৬০ ঘন্টা একটি ঢাকনা যুক্ত পাত্রে প্রায় তিন গুণ জলের সঙ্গে রেখে পচিয়ে নিতে হবে। এতে উপাদানগুলি গেঁজিয়ে যায়। এটিকে ছেঁকে নিয়ে পুকুরের জলে ছিটিয়ে দিতে হবে। এবং পরে বাকি শক্ত পদার্থটি পুকুরে ছড়াতে হবে। তবে একটি বিষয়ে মাথায় রাখতে হবে যে, বায়োফ্লক প্রয়োগের পরে আবার বেশি মাত্রায় চুন দিতে হয় (ডেসিম্যালে ৩০০ গ্রাম) এবং জলে এয়ারেশান দিতে হবে বা পাম্প দিয়ে জলের ফোয়ারা দিতে হবে।
সম্প্রতি জাতীয় মৎস্য উন্নয়ন নিগমের উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় এবং তামিলনাড়ু মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ প্রয়াসে ‘বায়োফ্লক প্রযুক্তি’র ওপরে তিনদিনের একটি কর্মশালা হয়। হলদিয়া ব্লকের বহু মাছ চাষি এতে অংশ নেন। জানা গিয়েছে, জাতীয় মৎস্য উন্নয়ন নিগমের এই উদ্যোগে তামিলনাড়ু মৎস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমন কর্মশালার মাধ্যমে মাছ চাষিদের এই নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানাচ্ছেন। সুতরাং, ব্যবসাভিত্তিক মাছ চাষের প্রধান খরচ মাছের খাবারে আর রোগ প্রতিরোধকারী ওষুধে চলে যায়। সেক্ষেত্রে যেমন বায়োফ্লক প্রযুক্তি একটি সাশ্রয়কারী পদ্ধতি। এমনকি, বিদেশে রপ্তানিযোগ্য বাগদা, ভেনামী চাষে বায়োফ্লোক প্রযুক্তি ব্যাবহারের মাধ্যমে চাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান তো হবেনই সঙ্গে চাষে হঠাৎ ভরাডুবির আশঙ্কা দূর হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.