শংকরকুমার রায়, রায়গঞ্জ: এ চালের ভাত নিয়মিত খেলে শরীরের ক্ষয় রোখার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় ম্যাজিকের মতো। কড়া কড়া ওষুধ নয়, এই চালের গুণে মারণ রোগ প্রতিরোধী শক্তি তৈরি হয় শরীরে। অন্তত গবেষকদের দাবি এমনই। আর সেই উন্নত ধরনের কালো চালের চাষ চলছে উত্তর দিনাজপুরে (North Dinajpur)। জংলি ধান ‘রুফি পগোন’-এর সঙ্গে দেশজ বাতসাভোগ এবং চেঙ্গা ধানের আন্তঃপ্রজাতির সংকরায়ণ ঘটিয়ে নতুন মডেলের কালো চালের উদ্ভবে অদূর ভবিষ্যতে কৃষিবিজ্ঞানে অভাবনীয় উন্নতির বিপুল সম্ভাবনার দরজা খুলে যেতে চলেছে। সেই পথে টানা নয় বছরের নিরন্তর গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ধাপ পেরলেন এক ধান গবেষক, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ডিন তথা উদ্ভিদবিদ্যার (Botany) অধ্যাপক সুভাষচন্দ্র রায়।
কালিয়াগঞ্জের (Kaliaganj) সীমান্তবর্তী ধনকৈল্য পঞ্চায়েতের উত্তর কাচনা গ্রামের পৈতৃক কৃষি জমিতে ৯ বছর ধরে ওই সংকরায়ণ ধান চাষ করে নতুন কালো ধান আবিষ্কারের লক্ষ্যে নানা পরীক্ষায় মগ্ন রায়গঞ্জের এই গবেষক। জুন-জুলাই বর্ষার মরশুমে আমন ধানের নবম প্রজন্ম (Ninth Generation) পর্যন্ত উৎপাদিত কালো চালে দেখা গিয়েছে জিনগত বৈশিষ্ট্যগুলি স্থায়ীকরণ হচ্ছে, তা নি:সন্দেহে চমকপ্রদ সাফল্য। মাত্র বিঘা তিনেক জমিতে সারি সারি প্রায় পাঁচশো ব্রিডিং লাইনে জেগে উঠেছে কালো ধানের গাছ। ১৩০ থেকে ১৪০ দিনের মধ্যে গাছে ফলন আসে। এক একটা ধানের শিসে ২০০ থেকে ৩০০টি করে ধানের দানা। সেখানে জেলার নিজস্ব তুলাইপাঞ্জি ধানের এক একটা শিসে সর্বোচ্চ ৯০ থেকে ১০০ ধানের দানা মেলে। একেবারের নতুন ধরনের কালো চাল তৈরির আবিষ্কারের অভূতপূর্ব স্বীকৃতি এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
এই আন্তঃপ্রজাতির নবম প্রজন্মের উৎপাদিত কালো ধানের খোসা ছাড়ালেই মিলছে লালচে এবং সাদা, বাদামি রং-সহ বহু ধরনের (ভ্যারাইটি) চাল। যা রীতিমতো নজিরবিহীন। উত্তর দিনাজপুরের জমিতে ফলানো নতুন মডেলের কালো ধান ইতিমধ্যে মুম্বই আইআইটির (Mumbai IIT) কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তাতে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট-সহ বিভিন্ন ভিটামিন, সেইসঙ্গে অ্যান্টি ক্যানসারের (Anti Cancer) বিভিন্ন উপকরণ মিলছে। এমনকী হৃদরোগ প্রতিরোধের বেশ কিছু গুণ পাওয়া গিয়েছে। পাশাপাশি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ-সহ শরীর চাঙ্গা রাখার যাবতীয় উপকরণ রয়েছে। এই নতুন ধানের অন্ন নিয়মিত খেলে ড্রাগের (Drug) নেশায় আসক্তদের এতদিনকার প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা বদলে নতুন দ্বার খুলে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে বলে রাসায়নিক পরীক্ষায় এমনই দাবি কৃষিবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞদের।
ইতিমধ্যে নতুন ধান ফলানোর প্রাথমিক স্বীকৃতি হিসাবে ‘ইউনিভার্সিটি অব এগ্রিকালচার সায়েন্স’ আয়োজিত নভেম্বরে বেঙ্গালুরুতে ২০ তম আন্তর্জাতিক আলোচনা সভায় ‘জংলি ধানের সঙ্গে আঞ্চলিক ধানের সংকরায়ণে নতুন মডেলের কালো ধান তৈরি’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তৃতায় অংশ নিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র রায়। তাঁর দাবি, “ওরাইজা রুফি পগোন জংলি ধানের সঙ্গে স্থানীয় ধানের ক্রস করে নাইন জেনারেশনের কালো ধান আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কোনও বৈজ্ঞানিক তৈরি করে দেখাতে পারেননি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রায়গঞ্জের জংলী ধান ‘রুফি পগোন’ থেকেই মূলত বিশ্বের কালো ধানের উৎপত্তি হয়েছে। এই হাইপোথিসিসটাই প্রমাণ করতে চলেছি। জমিতে ‘নাইন জেনারেশনে’র প্রায় পাঁচশো থেকে সাতশো ব্রিডিং লাইন তৈরি করে ফেলেছি।”
দিল্লিতে ‘প্রোটেকশন প্ল্যান্ট ভ্যারাইটিজ এন্ড ফার্মাস অ্যাক্ট ২০০১’-এর অনুযায়ী এই নতুন ধানগুলি প্ল্যান্ট ভাইটিজ রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্ল্যান্ট অথরিটির কাছে জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। পাশাপাশি জাতীয় জিন ব্যাঙ্কে সংরক্ষণের প্রস্তুতি চলছে। এ ব্যাপারে উদ্ভিদবিদ দিলীপ দে সরকার বলেন, “ধান গবেষণায় যুগান্তকারী পথ প্রদর্শক। এই পুষ্টিকর ধানের কালো চাল সাধারণ মানুষজনের খাবারের পাতে নিয়মিত পৌঁছলে অনেক রোগ নিরাময় ওষুধ ছাড়াই সম্ভব হয়ে যাবে।” তবে এ ব্যাপারে জেলা কৃষি অধিকর্তা সফিকুল ইসলাম বলেন, “ওই গবেষকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। প্রয়োজনে সরকারি ফার্মে এই ধান ফলানো সম্ভব কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।” অথচ আশ্চর্যজনক ঘটনা হল, একসময় রায়গঞ্জ শহরের অদূরে কাশীবাটি এলাকার জলাভূমি জুড়ে জংলি ধান রুফি পগোন দেখা যেত। কিন্তু সেগুলো সংরক্ষণ করার কোনও উদ্যোগ এতদিনেও সম্ভব হয়নি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.