অতুলচন্দ্র নাগ, ডোমকল: নবাবের জেলা মুর্শিদাবাদ যেমন আম, লিচুর জন্য বিখ্যাত তেমনই এই জেলার চাষিরা বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষে সমান পারদর্শী। সারা বছর এই জেলাজুড়ে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ হয়। বেলডাঙা যেমন কপি, কান্দি মহকুমা তেমন আলু চাষের জন্য পরিচিত। ঠিক একই ভাবে শিম চাষে বিখ্যাত এই জেলার লালবাগ ও ডোমকল মহকুমা। যদিও জেলার সব মহকুমা এলাকাতেই শিম জাতীয় সবজির চাষ হয়ে থাকে। প্রতি বছর জেলাজুড়ে প্রায় দেড় থেকে দু’হাজার হেক্টর জমিতে শিমের চাষ হয়। ডোমকল মহকুমায় প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে শিম চাষ করা হয়। বাজারে বিভিন্ন প্রকার শিমের চাহিদা থাকায় এই চাষে কৃষকেরা এখন খুবই আকৃষ্ট হচ্ছেন। কারণ, তাঁরা বুঝতে পেরেছেন শিম জমিতে থাকা মানেই পকেটে টাকার জোগান অব্যাহত থাকা।
সময়: শ্রাবণ-ভাদ্র মাস থেকে এই সবজির বীজ পুঁততে শুরু করেন কৃষকেরা। তবে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত বীজ লাগানো যায়। এজন্য জমিতে চাষ দিয়ে তৈরি রাখতে হয়। কোনও কোনও চাষি আবার শিমের বীজ পোঁতার আগে ওই জমিতে আলুর বীজ বপন করে নেন। আলু বেড়িয়ে গেলে দুই আলের ফাঁকে ফাঁকে গোল করে শিমের বীজ পুঁতে থাকেন। এ ক্ষেত্রে বীজ থেকে গাছ বের হয়ে একটু বড় হতেই আলু তোলার সময় হয়ে যায়। আবার অনেকে শুধু মাত্র শিম চাষের জন্যই জমি তৈরি করে নেন। তাতে আগাম শিম পাওয়া যায়। বাজারে ভাল দামও পাওয়া যায়।
জাত: শিমের মরসুম ভিত্তিক দু’ধরনের জাত রয়েছে। সেগুলি আবার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন পুসা আর্লি প্রলিফিক, পুসা শিম-২, জেডিএল-৩৭ ইত্যাদি। এগুলি বাহান বা মাঁচান পদ্ধতিতে চাষ করা যায়। এছাড়া, কিছু জাত আছে যেমন আর্কা জয়, আর্কা বিজয়, ইত্যাদি। এগুলি বছরভরই চাষ করা যায়। এই সব জাতের শিমের গাছ ঝোপের আকারে হয়। তা থেকে ভাল ফলনও পাওয়া যায়।
বপণের পদ্ধতি: লতানো জাতের শিম বীজ বিঘা প্রতি তিন থেকে পাঁচ কিলোগ্রাম আর ঝোপালো জাতের জন্য পাঁচ থেকে সাত কিলোগ্রাম পর্যন্ত বীজ লাগানো যেতে পারে। এগুলি নির্দিষ্ট দূরত্বে সারিবদ্ধভাবে লাগানো দরকার। লতানো জাতের গাছগুলি পাঁচ ফুট বাই তিন ফুট দূরত্বে এবং ঝোপ বা বেঁটে জাতের জন্য কম দূরত্বে লাগানো দরকার। তার মাপ আড়াই ফুট বাই আড়াই ফুট দূরত্ব হলেই চলবে।
চাষের প্রণালী: জমি তৈরির সময় প্রাথমিক সার হিসেবে বিঘা প্রতি ২০ থেকে ২৫ কুইন্টাল গোবর সার এবং ৪০ থেকে ৫০ কিলোগ্রাম নিম খোলের সঙ্গে দু’কিলোগ্রাম অ্যাজোফস জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। বীজ লাগানোর আগে ১০ : ২৬ : ২৬ অনুপাতে ১২ থেকে ১৫ কিলোগ্রাম সার হিসেবে মাটিতে মিশিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। পরে গাছ বের হওয়ার পর তিন সপ্তাহ বয়সে ও ছ’সপ্তাহ বয়সে চাপান সার হিসেবে পাঁচ কিলোগ্রাম ইউরিয়া, তিন কিলোগ্রাম পটাশ সার জমিতে দিয়ে সেচ দিতে হবে। এর সঙ্গে অনুখাদ্য হিসেবে বোরোন, জিংক, মিক্সচার দেড় থেকে দু’গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে গাছের পাতায় সরাসরি স্প্রে করে দেওযা যায়। প্রয়োজন মতো জল সেচ ও রোগ পোকা নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধও দেওয়া যেতে পারে। মাঝে মধ্যে প্রয়োজন বুঝে জমিতে হালকা জলসেচ দিতে হবে।
ছত্রাক নিয়ন্ত্রণ: ছত্রাকঘটিত রোগ যেমন পাউডারি মাইল্ড, ফাইটোপথোরা পোড্রট-এর আক্রমণ বেশি দেখা যায়। এছাড়া, ছত্রাক জাতীয় হলদে দাগ লাগার আক্রমণের ফলে ফসলের ক্ষতি হয়। আর পোকার মধ্যে থাকে স্টেমফ্লাই, থ্রিপস এবং মাইটের আক্রমণ। যেগুলি সুসংহত প্রক্রিয়ায় রোগ পোকা দমনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এক্ষেত্রে ট্রাইকোডারমা ভিরিডি তিন গ্রাম অথবা সাফ পাউডার দু’গ্রাম প্রতি লিটার জলে সঙ্গে আঠা মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। আবার পোকা দমনের জন্য নিম তেল তিন মিলিলিটার প্রতি লিটার জলে গুলিয়ে স্প্রে করা যায়।
ফসল তোলা: বীজ বোনার ৪৫ থেকে ৫০ দিন বাদে ফসল তোলা শুরু করা যেতে পারে। গাছে ফুল আসার পর ৭ থেকে ১২ দিনের মাথায় শিম সবুজ ফসল হিসেবে তোলা যায়। লতানো জাতের শিম বিঘা প্রতি ২০ থেকে ২৫ কুইন্টাল আর হাইব্রিড দশ বা ঝোপ ধরনের গাছে ৪০ থেকে ৪৫ কুইন্টাল পর্যন্ত শিম পাওয়া যায়। সময় মতো বাজার ধরতে পারলে কৃষকেরা এক এক বিঘা জমির উৎপাদিত শিম থেকে সমস্ত খরচ খরচা বাদ দিয়ে বীজ বোনার তিনমাসের মধ্যেই ১৮ থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করতে পারেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.