অর্ণব আইচ: ১২ এপ্রিল, ১৯২৪। চিনে পা রাখেন রবীন্দ্রনাথ। ৫০ দিনেরও বেশি সময় সেদেশে ছিলেন কবি। বলেছিলেন, “কেন জানি না চিনে এসে আমার মনে হয়, যেন নিজের দেশে ফিরে এসেছি।” চলে যাওয়ার সময় দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন, “আমার হৃদয় এখানেই রইল।” সেই অবিস্মরণীয় সফরের একশো বছর পূর্ণ হল সম্প্রতি। ১৪ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৬ জন ভারতীয় পণ্ডিত ও শিল্পীদের নিয়ে গঠিত প্রতিনিধি দল ‘রবীন্দ্রনাথের পথে পুনঃভ্রমণ’ করতে সাংহাই গেলেন।
রবীন্দ্রনাথ জীবনে তিনবার সাংহাই গিয়েছিলেন। সেই সময়ে, তিনি যে যাত্রীবাহী জাহাজে চড়েছিলেন তা হংকৌ হুইশান বন্দরে থেমেছিল এবং সাংহাই সফরের সময় তিনি সিমিং গ্রামে অবস্থান করেছিলেন। এবার ভারতীয় প্রতিনিধি দল হুইশান ওয়ার্ফের ধ্বংসাবশেষ এবং সিমিং গ্রাম পরিদর্শন করে এবং তাদের অনুভূতি একশো বছর আগের বসন্তে ফিরে গিয়েছিল।
১৫ এপ্রিল, সাংহাই ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফু জি হং সফররত প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বলেন যে, রবীন্দ্রনাথ চিনা জনগণের একজন পুরনো বন্ধু ছিলেন। তাঁর তিন বার চিন সফরের সবগুলোই সাংহাই থেকে শুরু হয়েছিল এবং সাংহাইয়ে শেষ হয়েছিল। তাঁর এবং সাংহাইয়ের মধ্যে একটি অবিচ্ছেদ্য বন্ধন তৈরি হয়েছিল।
সাংহাই সফরকালে, প্রতিনিধিদল সাংহাই পৌর আর্কাইভস ব্যুরো এবং সাংহাই চিনইউয়ান সিনিয়র হাইস্কুল পরিদর্শন করে, হুইশান ওয়ার্ফ সাইট, সিমিং গ্রাম এবং অন্যান্য স্থান পরিদর্শন করে যেখানে রবীন্দ্রনাথ পদচিহ্ন রেখেছিলেন। তারা নানচাং রোড এবং মাওমিং এর সংযোগস্থলে অবস্থিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। দলটি থংচি বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (Rabindranath Tagore) চিন (China) সফরের শতবর্ষ’ স্মরণানুষ্ঠানেও অংশ নেয়। চীন এবং ভারতের পুরনো ও নতুন বন্ধুদের মধ্যে আদান-প্রদান থেকে অনেক উষ্ণ মুহূর্ত এবং স্পর্শকাতর পর্বগুলি উদ্ভূত হয়েছে।
নানচাং রোড এবং মাওমিং সাউথ রোডের সংযোগস্থলের বাগানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ব্রোঞ্জমূর্তি নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। সৌরজা ঠাকুর তাঁর জুতো খুলে ফেলেন। রবীন্দ্রমূর্তির হাত আঁকড়ে ধরে শ্রদ্ধা জানাতে ঝুঁকে পড়েন। শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে বুনো চন্দ্রমল্লিকা, জুঁই, বেগুনি লিলি এবং পিওনি ফুলের একটি তোড়া রাখেন ব্রোঞ্জমূর্তির সামনে। বলেন, “রবীন্দ্রনাথের কবিতায় লেখা ফুল দিয়েই সাজানো হয়েছে তোড়া। এই মুহূর্তে, আমি তাঁর কাছাকাছি আছি বলে অনুভব করছি।”
রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মনোজ মুরলি নায়ার প্রথমবারের জন্য চিনে এসেছেন। সাংহাইয়ের রাস্তায় হেঁটে রবীন্দ্রনাথের ব্রোঞ্জমূর্তির সামনে একটি টুলে বসেছিলেন তিনি। গান গেয়ে ওঠেন। বলেন, “এখানকার রোদ, বাতাস, পাতা সবই আমার প্রকৃতির প্রতি আকুল আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে, যেন একশো বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মার সঙ্গে অনুরণিত হতে থাকে।”
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিনা ভবনের অধ্যক্ষ অধ্যাপক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তিনবার সাংহাই গিয়েছেন। এবং প্রায় প্রতিবারই তিনি ‘রবীন্দ্রনাথের পথে পুনঃভ্রমণ’ করেছেন। তিনি বলেন, “সাংহাই রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোকে এত ভালোভাবে সংরক্ষণ করেছে দেখে আমি খুব মুগ্ধ হয়েছি। সাংহাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন সফরের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এবং আমাদের হৃদয় এখানেই রইল।” তাঁকে বলতে শোনা যায়, “চিন ও ভারতের মধ্যে আদানপ্রদানের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, হাজার হাজার বছর ধরে বিস্তৃত দুটি প্রাচীন সভ্যতার সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথের বাস্তব তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ চিন থেকে ফিরে যাওয়ার পর, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চিনা ভবন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।” তিনি মনে করেন, চিনা সংস্কৃতি ও ভারতীয় সংস্কৃতি বিভিন্ন ছোট ছোট শহরে প্রচার করা উচিত, যার মাধ্যমে পারস্পরিক সমঝোতা আরও বাড়বে।
‘‘তুমি কি বাতাস দেখতে পাও?’’ ভারতীয় নৃত্যশিল্পী সৌরজা ঠাকুরের চোখে বাতাস হল ভাঁজ করা হাত, কুঞ্চিত হওয়া কাঁধ এবং মুখ উঁচু করে হাসি। সাংহাই চিন ইউয়ান সিনিয়র হাইস্কুলের নাচের শ্রেণিকক্ষে, তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খালি পায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতার নৃত্যরূপ দেখালেন: ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে বহে কিবা মৃদু বায়, তটিনী হিল্লোল তুলে কল্লোলে চলিয়া যায়। পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে কুহূ কুহূ কুহূ গায়, কি জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়! “এটি প্রকৃতির প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালবাসা। ভালবাসা সমস্ত দ্বন্দ্ব এবং সমস্যার সমাধান করতে পারে। ভালবাসা দিয়ে চীন এবং ভারতকে সংযুক্ত করতে পারে।” সৌরজা ঠাকুর এবার ‘দুটি ক্লাসে’ যোগ দিয়েছেন: একটি চিনিইউয়ান সিনিয়র হাইস্কুলের ছাত্রদের সঙ্গে এবং অন্যটি থংচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল এক্সচেঞ্জ স্কুলে সারা বিশ্বের ছাত্রদের সঙ্গে। একই সুর, একই তরুণ মুখ: তরুণরাই চীন ও ভারতের ভবিষ্যৎ, পাশাপাশি এশিয়া ও বিশ্বের আশা।
২০০৮ সালের প্রথম দিকে, চিনইউয়ান সিনিয়র হাইস্কুল এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মৈত্রী-স্কুল চুক্তি স্বাক্ষর করে। এটি ছিল প্রথম চিনা মিডল স্কুল যা ভারতের সাথে একটি মৈত্রী-স্কুল চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সফরের সময়, কিছু শিক্ষার্থী নাচের স্টুডিওতে ভারতীয় নাচ শিখছিল এবং অন্য একটি শ্রেণিকক্ষে একজন চীনা শিক্ষক ভারতীয় শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্যালিগ্রাফি শিখিয়েছিলেন। সৌরজা ঠাকুর বললেন, “ছাত্ররা মুখে হাসি নিয়ে খুব সুন্দর নাচছিল। আমি আশা করি তারা একদিন আরও বড় মঞ্চে অভিনয় করতে পারবে।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একশো বছর আগে চিন সফরের সময় বলেছিলেন, “আপাতদৃষ্টিতে বাধাগুলো পথ হয়ে উঠুক। আমরা যেন ভিন্নতাকে অস্বীকার না করি এবং পার্থক্য স্বীকার করেই একত্রিত হই!” সেই সুরই ধরা রইল চিনে যাওয়া প্রতিনিধি দলের সফরের স্পন্দনেও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.