এমন সব মানুষ-প্রসঙ্গ আর জীবনের চোরা দিক যা নিয়ে কখনও মুখ খোলেননি প্রসেনজিত্ চট্টোপাধ্যায়৷ নিয়মিতভাবে এখন বলছেন গৌতম ভট্টাচার্যকে৷ আজকের বিষয়: উত্তম কুমার৷
সেই সকালটা এত বছর পরেও এমন হুবহু মনে করতে পারি যেন আমার মোবাইলে কেউ ভিডিও করে তুলে রেখেছিল! আমি আর মা বসে কথা বলছি৷ হঠাত্ একটা ফোন এল৷ মা ফোন ধরে বললেন, সে কী, সে কী! ফোনটা ছেড়ে চুপ করে বসে রইলেন৷ আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না যে কী হয়েছে৷ মা এবার আমাকে কাছে ডাকলেন৷ ধরা গলায় বললেন, “বুম্বা শোন, মাথার উপর থেকে বটগাছটা চলে গেল৷ তোর উত্তমজেঠু আর নেই৷”
কত বয়স হবে তখন আমার? আঠারো-উনিশ৷ একেবারে ছোট তো নই৷ কিন্তু শোনামাত্র কেমন অসহায় বোধ করতে শুরু করি৷ ইন্ডাস্ট্রিতে তত দিনে আমার স্ট্রাগল শুরু হয়ে গিয়েছে৷ ‘বিশ্বজিতের ছেলে’ হয়ে পরিচিত সমাজে ঘুরঘুর করা৷ আর ‘বুম্বা’ হয়ে নিজের জন্য জমি জোগাড় করা–দুটোর তফাত যে কী ভয়ানক সেই অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছে৷ সেই আগ্নেয়গিরির হলকার মধ্যে একমাত্র স্নেহছায়া উত্তমজেঠু৷ যিনি আমাকে নিয়ে ‘সাহেব’ করবেন ঠিক করে ফেলেছেন৷ কাস্টিংও ঠিক৷ আমি আর সোমা৷ সৌমিত্রকাকুও আছে৷ সৌমিত্রকাকুর ফিল্মে ডাবল রোল৷ বিরাট একটা সম্ভাবনার মুখ খুলব খুলব করছে৷ তার মধ্যে এ কী খবর?
দ্রুত রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলাম ভবানীপুর৷ যেতে যেতেও ভাবছি আর মাথাটা শুকিয়ে গোটা শরীর ঝিমঝিম করছে৷ উত্তমজেঠু নেই৷ আমার গোটা সংসার তো ছায়াহীন হয়ে গেল৷ মাত্র ক’দিন আগেও তো সুপুরুষ মানুষটা আমার পিঠে হাত দিয়ে বলেছে, “কোনও চিন্তা করিস না৷ তুই তো আমাদের ঘরের ছেলে৷” সত্যি তো ঘরের ছেলে৷ আমরা দু’টো পরিবার এমনভাবে ছিলাম যেন একই বাড়ির৷ আমার বাবা ছিলেন বুড়োজেঠু মানে তরুণকুমারের অভিন্নহৃদয় বন্ধু৷
বাবা তত দিনে বোম্বাইয়ের একজন টপ স্টার৷ আমরা হাঁ করে দেখতাম ওখানে ওঁকে নিয়ে কী মাতামাতি৷ অথচ কলকাতা এলেই বাবা যেন অন্যরকম আবরণে নিজেকে মুড়ে ফেলতেন৷ বোম্বাইয়ের পোশাক কখনও এখানে ইউজ করতে দেখিনি৷ আলাদা ওয়ার্ডরোব ছিল এখানে৷ আর কলকাতা এলে উনি কখনও বোম্বাইয়ের টপ স্টার নন৷ টালিগঞ্জের টপ স্টারের ছোট ভাই! আজও কেউ যদি আমার শান্ত সৌম্য বাবাকে খেপিয়ে দেওয়ার শর্ট কাট রাস্তা জানতে চায় আমি বলতে পারি৷ জাস্ট গিয়ে ওঁর সামনে উত্তমকুমারের নিন্দা করে আসুন৷ আমি শিওর এই বয়সেও উত্তেজিত তো হবেনই৷ হাতটাতও চলতে পারে৷
আমাদের আজকের টালিগঞ্জের কল্পনা করতে পারবে না কী বন্ধুত্ব আর হাসিঠাট্টার পরিবেশে যে প্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক-নায়িকারা এনজয় করতেন৷ বাবা প্রতিবার একটা রয়্যাল স্যালুটের বোতল নিয়ে আসতেন৷ রয়্যাল স্যালুট আজ মাহাত্ম্য খোয়াতে পারে৷ তখন ক্রেজ ছিল৷ ছোট একটা ঘরে গিয়ে বাবা, উত্তমজেঠু, বুড়োজেঠু, উৎপল দত্ত এঁরা বসতেন৷ থাকতেন সৌমিত্রকাকু৷ কিন্তু বোতলটা খোলার অধিকার ছিল উত্তমজেঠুর৷ আমার বাবার কাছে উনি শুধু স্নেহশীল দাদা ছিলেন না৷ ছিলেন অঘোষিত ক্যাপ্টেন৷
ভবানীপুরে যখন পৌঁছলাম লোকে লোকারণ্য৷ কোথায় গৌরী জেঠিমা? দেখার চেষ্টা করছি৷ বেণু আন্টি যেমন ছোটবেলা থেকে আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ৷ গৌরী জেঠিমাও তাই৷ আমার যখন পৈতে হয়, তিন দিন দণ্ডিঘরে থাকতে হয়েছিল৷ তখন জেঠিমা এসে আমাকে প্রণাম করে যান৷ আমি তো অবাক৷ উনি মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ছিলেন, বাবা ব্রাহ্মণকে প্রণাম করতে হয়৷ ওঁর ড্রেসটা আজও মনে আছে৷ পা থেকে মাথা অবধি গয়না৷
লরিতে তোলা উত্তমজেঠুর বডির কাছে পৌঁছচ্ছি আর এক একটা ফ্রেম যেন ঝলক দিয়ে যাচ্ছে৷ তখনও ভাবতে পারছি না এই সেদিন সেই বিখ্যাত হাসি দেখলাম৷ জেঠুর আদর পেলাম৷ সেই মানুষটা কী করে এভাবে চলে যেতে পারে?
বাবা তো তখন আমাদের সঙ্গে নেই৷ বোম্বাইতে৷ মা-র সদ্য মালাইচাকি অপারেশন হয়েছে৷ বেড রেস্ট৷ ওঁর আসার উপায় নেই৷ আমি এসেছি আমাদের পরিবারের প্রতিনিধি হয়ে৷ কিন্তু সামনে যা ঘটছে তা তো ফিল্মের চেয়েও বেশি৷ পাগলের মতো মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ছে লরির সামনে৷ যেখান দিয়ে বডি যাচ্ছে আশেপাশের সব বাড়ির জানালা খোলা৷ মহিলারা বাইরে৷ মানুষ কাঁদছে, দৌড়চ্ছে, মালা ছুড়ছে৷ লরিতে ততক্ষণে আমি উঠে গিয়েছি৷ দেখলাম বডির উপর ছাতা ধরছে সবাই৷ মৃত মানুষটারও যেন রোদ্দুর না লাগে৷ সম্মোহিতের মতো দেখে যাচ্ছিলাম৷ পুরো কলকাতা শহরের হার্ট যেন এই একটা লোকের মৃত্যু এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে৷ ধন্য এমন স্টারডম৷ বারবার ড্যাডির কথাগুলো মনে হচ্ছিল৷
ড্যাডি বলতেন, “শুধু আমি সম্মান করি না রে, পুরো বোম্বাই ইন্ডাস্ট্রি ওই লোকটাকে কুর্নিশ করে বুঝলি? রাজেশ খান্না আমার সামনে বসে ‘নিশিপদ্ম’-র এক-একটা সিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখেছে আর ‘অমর প্রেম’-এ কপি করেছে৷” তখনই এটা শোনা যে দু’টো সিন আছে যেগুলো রাজেশ নাকি বারবার চালিয়ে দেখতেন৷ একটা যেখানে উত্তমজেঠু দেশলাইয়ের কাঠিটা ঘোরাচ্ছেন৷ আর একবার সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে ডাকা–পুষ্প, ও পুষ্প৷
সংবাদ প্রতিদিনের কফিহাউসের জন্য লেখাটা ভাবতে গিয়ে হিসেব করলাম সাঁইত্রিশ বছর হয়ে গেল সেই ভয়ঙ্কর দুপুরটার৷ কেউ বলবে? কেউ বলবে উত্তমকুমার নেই? আজও তাঁর মৃত্যুদিনে কাগজগুলো স্পেশাল ইস্যু করে৷ চ্যানেলে চ্যানেলে প্রোগ্রাম হয়৷ মৃত্যুদিনে যা রুটিন, জন্মদিনেও তাই৷ পৃথিবীতে আর কোনও অভিনেতা আছে, কোনও স্টার আছে যে সে চলে যাওয়ার সাঁইত্রিশ বছর বাদেও সমানভাবে আলোচিত হয়? আজও বাঙালি তাঁর মৃত্যুদিন-জন্মদিনে সমান উদ্বেল৷
আমার মতে শুধু স্টারডম এর কারণ হতে পারে না৷ এটা তখনই সম্ভব যদি মানুষটা তার শিল্পের মাধ্যমে পরিবারের একজন হয়ে উঠতে পারে৷ আমার ছেলে মিশুক হয়তো উত্তমকুমারের সিনেমা বসে দেখে না৷ কিন্তু উত্তমজেঠুর নামটা শুনে বড় হয়েছে৷ প্রত্যেক বাঙালি পরিবারেই উত্তমকুমার আজও একজন অদৃশ্য সদস্য৷ ‘মহানায়ক’ সিরিয়ালটা করতে গিয়ে উত্তমজেঠুর উপর আরও বেশি করে স্টাডি করতে হয়েছিল৷ বেশ কিছু হোমওয়ার্ক করেছিলাম৷ একটা কথা ভেবে খুব আশ্চর্য লাগত৷ মানুষটার উপর দিয়ে এত ঝড় জল গিয়েছে৷ অথচ ক্যামেরায় তা ধরা পড়েনি৷ কিছু কিছু ঘটনার ছোটবেলায় আমিও সাক্ষী৷ সেগুলো না-ই বা বললাম৷ অনেক চর্চা সেসব ঘটনা নিয়ে হয়েছে৷
আমার এই বয়সে এসে যেটা ভাবলে রোমাঞ্চিত লাগে তা হল, চেহারায় ব্যক্তিগত জীবন ছাপ ফেলতে না পারার একটাই সহজ ব্যাখ্যা৷ মানুষটা তার মানে ধর্ম মেনে তাঁর কাজটা করত৷ যখন কেউ নিজের পেশাকে ধর্ম আরাধনার মতো নিতে পারে সে একটা অন্য স্তরেই উন্নীত হয়ে যায়৷ তখন সংসার ধর্ম সব কিছুই তার কাছে মূল ব্যাপারটাকে ঘিরে ঘটতে থাকা নানা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়ে যায়৷
উত্তমজেঠুর আরও একটা গুণ ছিল নায়কের ক্যারেক্টরের বাইরেও সব সময় নায়কোচিত থাকা৷ উনি মারা যেতে শুধু আমার মাথার উপর থেকে বটগাছ উধাও হয়ে যায়নি৷ অনেকেরই জীবনে আকাশ ভেঙে পড়েছে৷ কত টেকনিশিয়ানকে যে উনি সাহায্য করতেন তার কোনও ইয়ত্তা নেই৷ প্রকৃত অর্থে ইন্ডাস্ট্রির দয়ালু অভিভাবক ছিলেন উনি৷ প্রায় প্রতিদিন কাউকে না কাউকে সাহায্য করতেন৷ একটাই শর্ত থাকত, সেই উপকারের কথা বাইরে বলা যাবে না৷ আমার ফিল্ম কেরিয়ারে এমন মানুষ আর দেখিনি৷ সাধারণ মেক আপ আর্টিস্টকে প্রোডিউসার বানিয়ে উনি তাঁর ছবি করে দিয়েছিলেন৷ একবার কোনও সিনিয়র অভিনেতা ওঁকে অপমান করেছিলেন৷ পরবর্তীকালে সেই অভিনেতা যখন বিপন্ন আর স্টুডিওতে কাজ চাইতে এসেছেন, তখন উত্তমজেঠু তাঁকে ফেরাননি৷ বদলা নেওয়া-টেওয়ার মানসিকতাই ওঁর ছিল না৷ এই ঘটনাটা আমরা ‘অটোগ্রাফ’ করার সময় রেখেছিলাম৷ আজ আবার মনে পড়ে গেল৷ এটাও মনে হল, হ্যাঁ মহানায়ক একেই বলা উচিত!
উত্তমজেঠুকে ঘিরে কন্ট্রোভার্সি তো কম হয়নি৷ এত রূপবান একজন মানুষ৷ তা-ও এত সাকসেসফুল৷ সুন্দরীদের তো আকর্ষিত হওয়ারই কথা৷ কিন্তু আমার মনে হয় না সেগুলো বাঙালি জীবনের শেষ মূল্যায়নে কোনও ছাপ ফেলতে পেরেছে বলে৷ উঠে আসার রাস্তায় সমালোচনা, ব্যর্থতা, গুঞ্জন কোনও কিছুই তো ওঁকে ছাড়েনি৷ শুরুর দিককার পরপর ছবি ফ্লপ হচ্ছিল বলে লোকে ঠাট্টা করত, এই যে ফ্লপ মাস্টার জেনারেল যাচ্ছে৷ কত রকম অপমান৷ গলা নিয়ে কটাক্ষ করত৷ বলত নায়ক হবে এই সরু গলা নিয়ে৷ কেউ বলত এটা নায়কের চাউনি হল? এ তো লক্ষ্মীট্যারা৷
পরবর্তীকালে কী অসম্ভব অধ্যবসায়ে উত্তমজেঠু এই সব ক’টা নেগেটিভকেই পজিটিভ করে নিয়েছিলেন৷ যাঁকে লক্ষ্মীট্যারা বলে বিদ্রূপ করা হত, তাঁর শুধু চাউনিটাই আইকনিক হয়ে গেল৷ কীভাবে নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে নিয়ে গেছেন ভাবা যায় না৷ একটা সময় প্রেমিক৷ একটা সময় ট্র্যাজিক৷ আবার তারই মধ্যে ‘বিচারক’-এর মতো একটা ফিল্ম করেছিলেন যেখানে ওঁর রোলটা অ্যান্টি-হিরোর৷
উনি আমাদের মতো নায়কদের কাছে দৃষ্টান্ত বললে কম বলা হয়৷ দৃষ্টান্ত এমন কেউ যাঁকে মেধায়-চেষ্টায় ছোঁয়া যায়৷ সমকক্ষ হওয়া যায়৷ উত্তমকুমারকে ছোঁয়া যাবে কী করে? তিনি তো স্বয়ং টেক্সট বই! তাঁর দিকে সম্ভ্রমে তাকানোই যায়৷ ছোঁয়ার চেষ্টা পাগল ছাড়া কেউ করবে না৷ মৃত্যুদিনের সবে তো সাঁইত্রিশ বছর হল৷ আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বলে এই আবেগ চলতেই থাকবে বাঙালি জীবনে৷ আমরা চলে যাব সময়ের সঙ্গে৷ পরের পরের জেনারেশনও হারিয়ে যাবে পৃথিবী থেকে৷ কিন্তু আজ থেকে ১৩৭ বছর পরেও ২৪ জুলাই দিনটায় বাঙালির শোকার্ত হওয়া থামবে না! অনেক বড় স্টার নিশ্চয়ই আসবে-যাবে৷ উত্তমজেঠুর মতো কাউকে ১৩৭ বছরেও পাওয়া যাবে না৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.