সাত দিন বন্ধ। রাজ্যজুড়ে যেন জাতীয় শোক চলছিল। সিরিয়ালকে আমরা ঘরের এত কাছাকাছি সমুদ্র হতে দিলাম কেন? কফিহাউস বিতর্কে উপস্থিত ছিলেন অভিনেত্রী কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, লেখক সংগীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অধ্যাপক অভীক মজুমদার, স্ক্রিপ্টরাইটার অদিতি মজুমদার গৃহবধূ সুমিতা দত্ত। সূত্রধার ইন্দ্রনীল রায় এবং ভাস্কর লেট।
[‘বাবুমশাই’ হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুদিনে স্মৃতিচারণায় প্রভাত রায়]
ইন্দ্রনীল: আটাত্তরের বন্যা। ভারতের বিশ্বকাপ বিপর্যয়। মোহনবাগান হারলে ঘটিদের দুঃখ। ইস্টবেঙ্গলের হারে বাঙালদের শোক। চরম হাহাকারের তালিকায় নবতম সংযোজন– বাংলা সিরিয়াল সাত দিন বন্ধ থাকা। বাড়িতে বাড়িতে যেন অশৌচ চলছিল। এটাকে কী ভাবে দেখছেন কনী?
কনীনিকা: আমি অবাক হয়েছি। আমাকে অনেকে হোয়াটসঅ্যাপ করেছিল যে তারা ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছে যেন তাড়াতাড়ি স্ট্রাইক উঠে যায়। যে দিন দিদি (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) মিটিং ডেকেছিলেন, সকাল থেকে আমার কাছে মেসেজ এসেছে– আজ সব ঠিক হয়ে যাবে, কাল থেকে তুমি আবার সেটে যাবে। ওঁর ঘোষণা জানার আগেই আমার কাছে এসএমএস এল, ‘দেখলে তো ঠাকুর কথা শুনেছে।’ আমি অবাক যেমন হয়েছি, তেমন এটাও মনে হয়েছে, অভিনেত্রী হিসেবে দর্শকদের এতটা কাছে যেতে পেরেছি।
আসলে এক-একজন মানুষের এক-এক রকম চাহিদা থাকে। কিছু বাচ্চার বিকেলে ক্রিকেট খেলতে যেতেই হবে। কাউকে সকালবেলা ম্যাগি বানিয়ে দিতেই হবে। সে রকমই বড় বয়সের চাহিদা হয়তো বাংলা সিরিয়াল। সেই চাহিদাটা ভেতরে এমন কোনও হরমোন আনছে যেটা আনন্দ দিচ্ছে, একাকীত্ব ঘোচাচ্ছে। তাই আমি এটাকে ভ্যালু দিয়েছি। আর এটা আমার দায়িত্ববোধ যে আমি যেন আমার দর্শকদের না ঠকাই। একজন মানুষ এতটা ভাবছেন আমাকে নিয়ে, এসএমএস করছেন, সেটা তো সময় অপচয় করে করছেন। কোথাও তাঁর মনে আমি জায়গা করে নিয়েছি। দর্শকদের কিংবা আমার বাবা-মায়ের কথা ভেবে মনে হয়েছে, এই হাহাকারটা জাস্টিফায়েড। তাঁরা সিরিয়াল-নির্ভর মানুষ। সিরিয়াল দেখে এন্টারটেনড হন।
ইন্দ্রনীল: অভীকদা, সিরিয়ালের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে আগ্রহ ছিল, অনেকটা মাধ্যমিক রেজাল্ট জানার মতো যে, আমি পাশ করলাম না ফেল। এটা কি বাঙালি সমাজের অধঃপতন?
অভীক: অধঃপতন আমি কিছুতেই মনে করি না। শুধু অনুবাদের দিক থেকে ভাবলে আর্ট এবং ইন্ডাস্ট্রি বাংলায় দু’টোই শিল্প। বাংলায় ওই দু’টো শব্দের আর কোনও প্রতিশব্দ নেই। আর্ট এবং ইন্ডাস্ট্রি দু’টো যদি সরে যায় আর বাংলার একটা বড় অংশ এ ভাবে হাহাকার করে, তা হলে বাঙালি হিসেবে আমি গর্বিত বোধ করি। আমি কী দেখি, কী দেখি না বা তার মান কী, সেটা পরের প্রশ্ন। প্রথম কথা এটা আর্ট ফর্ম, দুই এটা ইন্ডাস্ট্রি।
ইন্দ্রনীল: সুমিতাদির কাছে জানতে চাই। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। সন্ধেবেলা কোথাও যাওয়ার নেই। ছেলে বড় হয়ে গেছে। হাজব্যান্ড ক্রিকেট দেখেন। আমায় ‘বকুলকথা’, ‘রাণী রাসমণি’ নিয়েই থাকতে হবে। এই সাত দিন আপনার বাড়ির পরিস্থিতি কেমন ছিল? এটা তো বাড়ির কাজের লোক না আসার মতো?
সুমিতা: বাড়ির কাজের লোক তো মাঝে মাঝেই আসে না। ওটা আমাদের সয়ে গিয়েছে। এটা পুরো ভাটিখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো।
অদিতি: আমার আপত্তি আছে। ভাটিখানার সঙ্গে এটার কেন তুলনা হবে?
সুমিতা: আমি নেশাটার কথাটা বলছি।
অভীক: গ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে গেলে কি আমরা বলব ভাটিখানা বন্ধ হয়ে গেল?
কনীনিকা: অবসর থাকলেই সিরিয়াল দেখব, এটায় আমার সমস্যা আছে। ‘অন্দরমহল’ যখন টপে ছিল, যারা চাকরি করে তারাও কিন্তু সাড়ে ন’টার মধ্যে ফিরে সিরিয়ালটা দেখত।
অদিতি: এই যে একটা এলিট কমিউনিটি ঠিক করে দিচ্ছে কোনটা রুচি, কোনটা কুরুচি, এটা খুব গোলমেলে। এন্টারটেনমেন্ট তো সবার। আর এমন কোনও নিখিল ভারতীয় কনটেন্ট আজ অবধি তৈরি হয়েছে কি যেটা শুরু থেকে শেষ এলিট থেকে একদম নিচু শ্রেণির ‘অশিক্ষিত’ মানুষ দেখে? ‘পথের পাঁচালী’ দেখেছিল মানুষ?
ইন্দ্রনীল: দেখেনি।
অদিতি: আমি যখন ‘এক আকাশের নীচে’তে কাজ করছি, তখন কম্পিটিশন অনেক কম ছিল। কিন্তু তখনও দেখেছি অন্য চ্যানেল টিআরপি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে আর আমরা লাট খাচ্ছি। তবে যে দিন কনীর বোন টুসকি একটা খুন করে ফেলল, সে দিন টিআরপি ছিল ১৪। তা হলে খুন কারা দেখে? কুরুচিই যদি বলতে হয় তা হলে তো কোনও সাহিত্য পড়া যাবে না। কুরুচি বলতে বোঝানো হচ্ছে তিনটে বউ, চারটে বিয়ে। এগুলো সাহিত্যে নেই?
ইন্দ্রনীল: সংগীতা, স্ক্রিপ্টরাইটার অদিতি বা লীনা গঙ্গোপাধ্যায় কি সমসাময়িক লেখকদের চেয়ে আপনার বড় কম্পিটিটর?
সংগীতা: কখনওই হতে পারে না। বাংলা সিরিয়ালের স্ক্রিপ্টরাইটারকে ‘অথার’ বলা হয় কি না সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। অথার হচ্ছে মেনস্ট্রিম সাহিত্যের লেখক। স্ক্রিপ্টরাইটিং অন্য ক্ষেত্র।
অদিতি: স্ক্রিপ্টে কিন্তু একটা গল্প লেখা হয়। পরে সেটা ভাঙা হয় স্ক্রিনপ্লে আর ডায়ালগে। মূল গল্পটা একজনই লেখেন। তা হলে তিনি কি মূলস্রোতের ‘অথার’?
সংগীতা: তাঁর বই আছে কি না জানতে হবে। সে বই বিক্রি হয় কি না। তাঁর পাঠক আছে কি না।
ইন্দ্রনীল: সংগীতা, ধরুন আপনি একটা পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছেন। সাত দিন আপনার লেখা বেরোল না। এই হাহাকারটা হবে যেটা সিরিয়াল নিয়ে হল? তা হলে কে বেশি জনপ্রিয়?
সংগীতা: এটা তো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। সিরিয়াল একটা নয়, সব একসঙ্গে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখানে আর্টের ক্রাইসিস ছিল। এতগুলো মানুষের রুটি-রোজগার, এটা অনেক বড় সমস্যা। সেখানে লেখক একা বসে লেখেন। তিনি যদি কোনও কারণে কাজ না করতে পারেন, তাঁর শরীর খারাপ হল বা তিনি মারা গেলেন, এত বড় ইম্প্যাক্ট হবে না। দুঃখ হতে পারে। যেমন সমরেশ বসু যখন মারা গিয়েছিলেন ‘দেখি নাই ফিরে’ লিখতে লিখতে, তখন একটা নীতি বদলে গেল যে আর ধারাবাহিক উপন্যাস ছাপানো হবে না। সেটা আলাদা ব্যাপার। তবে আমি সিরিয়াল খুব কম দেখি। খুব কম পড়ি।
[কেন বলিউডে থেকেও আলাদা কাজল? উত্তর দিলেন ঋদ্ধি]
ইন্দ্রনীল: আপনার পাঠক—পাঠিকা তো সিরিয়ালের দর্শক। লেখিকা হিসেবে আপনি জানবেন না তাদের রোজকার কনজাম্পশন কী? এতটা বিচ্ছিন্ন থাকা কি উচিত?
সংগীতা: যখন একজন পাঠক সিরিয়াস লেখকের বই পড়ছে, তখন সে একটা আলাদা আইডেন্টিটি। যখন সেই পাঠক সিরিয়াস বই বন্ধ করে টিভি দেখছে, সে আরেকজন হয়ে যাচ্ছে। আমিও হয়তো সিরিয়াস কিছু দেখতে দেখতে অন্য কিছুতে সুইচ অন করলাম।
ইন্দ্রনীল: অদিতি কিছু বলবেন?
অদিতি: একটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। (ব্যঙ্গের সঙ্গে) এই ইন্ডাস্ট্রিতে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা ‘অশিক্ষিত’…
সংগীতা: এই ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই যাদবপুর-প্রেসিডেন্সির ছাত্রছাত্রী। অশিক্ষিত বলাটা ভুল।
কনীনিকা: অসুবিধেটা হয়ে গেছে যে এই জেনারেশন এবং আমাদের জেনারেশন বই পড়াটা কমিয়ে দিয়েছে। আমি আমার ছেলেকে চেষ্টা করেও একটা বই ধরাতে পারি না।
সুমিতা: বাংলা বইয়ের অবস্থা তো আরও খারাপ।
কনীনিকা: যখন লীনাদির স্ক্রিপ্ট আসত, দীর্ঘ প্রতীক্ষায় বসে থাকতাম। ওঁর স্ক্রিপ্টে কোথাও সাহিত্যের ছোঁয়া আছে। এমন কিছু শব্দ আছে, যা আমি শুনতে চাইছি এবং বলতেও চাইছি। এটা বলতেই আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
অভীক: ‘সাহিত্য’ বা ‘টেক্সট’ শব্দগুলো আমরা খুব আলগা ভাবে ব্যবহার করি। রাস্তার একটা বিজ্ঞাপনও তো টেক্সট। একটা লেখা টেলিভিশনে অভিনীত হলে সেটাও টেক্সট। নাটক কি সাহিত্য নয়? স্ক্রিপ্টও সাহিত্য। সত্যজিৎ রায়ের স্ক্রিপ্টগুলো যেমন একত্রিত হয়ে বেরোচ্ছে। তার কিছু অন্য সাহিত্যিকের লেখা, কিন্তু সত্যজিৎবাবুর নিজের লেখা স্ক্রিপ্টও আছে। সেটাও তো সাহিত্যের অঙ্গ। বই হলেই সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হবে, এটা আধুনিক চিন্তাধারা বলে না। সংগীতা বলছিলেন, “আমি একটা সিরিয়াস বই পড়ছিলাম। টিভি খুললাম, খুলে একটা হালকা জিনিস দেখলাম।” কোথাও আমাদের ভিতরে এটা কাজ করে যে বইটা সিরিয়াস, আর টিভিতে যা দেখানো হচ্ছে সেটা হালকা।
সংগীতা: উলটোটাও হতে পারে। যে আমি সস্তা চটুল একটা কিছু পড়ছি। তার পর টেলিভিশনে সিরিয়াস কোনও খবর দেখলাম।
অভীক: টেলিভিশনের খবর নিয়ে কথা বলছি না। এন্টারটেনমেন্ট চ্যানেলেও এমন অনুষ্ঠান হতে পারে যেখানে সাহিত্য আছে।
সংগীতা: সেটা হলে কিছু টেকনিক্যাল বিষয়ের মধ্যে যেতে হয়। টিভি সিরিয়ালে ওই সত্তরবার মুখের কাটিং আমি দেখতে পারব না। একটা টার্নকে পাঁচবার দেখানো হচ্ছে।
কনীনিকা: এটা তো একটা আলাদা শিল্পমাধ্যম।
অভীক: বই পড়তে গেলেও আমরা এটা ফেস করি।
সংগীতা: সিনেমাতেও। ‘ওশান’স এইট’ দেখতে গিয়ে যেমন পাঁচটা সিন দেখে বেরিয়ে এসেছি। এত ঝুল ছবি।
ইন্দ্রনীল: আচ্ছা, সিরিয়ালে কোথাও একটা এক্সেস কি আছে? যে কারণে অন্যতম বড় দর্শক মুখ্যমন্ত্রী বাধ্য হচ্ছেন বলতে যে, সিরিয়ালে সবার চারটে প্রেম, পাঁচটা বিয়ে?
অদিতি: ডেফিনিটলি আছে। কারণ এর সঙ্গে ব্যবসা জড়িত। এখানে টিআরপি হলে বিজ্ঞাপন হয়। এটা নিয়ে মিনিট টু মিনিট অ্যানালিসিস বসে প্রতি সপ্তাহে। সেখানে দেখি ‘সাত ভাই চম্পা’ যখন দেখাচ্ছে আনন্দভূমি থেকে রংধনু আনা হচ্ছে, সেটা টিআরপি দিচ্ছে না। কিন্তু ‘দেবী চৌধুরাণী’র ধর্ষণের দৃশ্য টিআরপি দিচ্ছে। এখন আমরা কী করব বলে দিন?
ভাস্কর: আপনারা ইনসাইডার হিসেবে কী প্রতিবাদ করছেন? দর্শক যে ঝগড়া-ধর্ষণ-চুলোচুলি পছন্দ করে, এটা কি আপনাদের একঘেয়ে লাগে? মনে হয় যে পরিস্থিতিটা বদলানো দরকার?
অদিতি: দরকার।
ভাস্কর: আপনারা তা হলে কী করছেন?
অদিতি: রিগ্রেসিভ জিনিস আমি কোনও দিন লিখিনি।
সংগীতা: আমি যখন সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লিখতে যাই, আমাকে বলা হয়েছিল, শোনো কাদের জন্য সিরিয়াল বানাচ্ছি। যে মেয়েটি রাতে তার স্বামীর হাতে মার খায়, সকালে উঠে সেই স্বামীকেই পান্তাভাত দেয় এবং জানে যে স্বামী চলে গেলে তার আর কেউ নেই, ওই মেয়েটার কথা ভেবে সিরিয়াল তৈরি।
কনীনিকা: আমি পরমেশ্বরী চরিত্রটার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আমি নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। অনেক বয়স্ক মানুষকে মিট করেছি। তাঁরা আমাকে জড়িয়ে কানে-কানে বলেছেন, এত দিন ধরে যা যা বলতে পারিনি, তুমি বলছ। আমরা তোমার থেকে শিখছি। হায়দরাবাদ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পঁচাত্তর বছরের মহিলা জড়িয়ে ধরে বলেছেন। কলকাতাতেও।
সিরিয়াল বন্ধ থাকার সময় আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় সিরিয়াল নিয়ে পোস্টগুলো পড়েছি। যাদের কাছে এত সময় আছে সিরিয়ালগুলোকে গালিগালাজ করার, তাদের কাছে এই সময়টাও আছে সিরিয়ালগুলো দেখার। টিআরপি তো তারাই তুলছে। ধর্ষণের সিনে যদি টিআরপি না ওঠে তা হলে তো সঙ্গে সঙ্গে অন্য কনটেন্ট লেখা হত।
[নচিকেতা, রূপঙ্করদের আড্ডা ছিল শ্যামবাজারের এই চায়ের দোকানে]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.