সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ‘যা যায়, যায় রে ভাইস্যা ভাটির টানে/ অনন্ত ভাসানে কান্দে ভাটিয়ালি গানে,/ যারে ভাসায় দিসো যাইবারে দাও/ দেইখ্যো না তার পানে…’
নাহ, বিসর্জনের পর আর ফিরে তাকাতে নেই৷ তবু কেউ কেউ থাকেন, যাঁর ভাসান নেই৷ প্রতিমা তো নরম মাটির৷ জলের ঢেউ তার সয় না৷ তবু সময়ের জল কাউকে চাইলেও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে না৷ জেগে থাকে অনন্ত স্মৃতি৷ উজানস্রোতে ভাসতে ভাসতে প্রিয় বন্ধুকে ফিরে পেতে মন চায়৷ আলোর বৃত্তের বাইরে, নিজস্ব স্মৃতির অন্ধকারে প্রিয় বন্ধুর মুখোমুখি বসতে ইচ্ছে করে৷
চলে যাওয়ার কথা তো ছিল না৷ তবু জীবন দুর্বিনীত৷ কখন যে কোন খেয়ালে সে কাকে কেড়ে নেয় তার ঠিক নেই৷ ফলে সত্যি এই, কালিকাপ্রসাদের চলে যাওয়ার বছর ঘুরে গেল৷ খাঁ খাঁ শূন্যতা৷ স্বজনবিয়োগ৷ ব্যথার জাগপ্রদীপ আজও জ্বলছে৷ সে কথাই মনে করেই আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখলেন তিন বন্ধু৷
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় (পরিচালক)
কালিকাকে মিস তো করি৷ আমার কাছে ওর চলে যাওয়া স্বজনবিয়োগের মতোই বেদনার৷ এখন যে পৃথিবীটায় ও থাকে, তা সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নেই৷ তবে একটাই কামনা, ওখানেও যেন ও গান-বাজনা নিয়ে ভাল থাকে৷ ও তো গানপাগল ছিল৷ আর সকলের সঙ্গে মিলেমিশে, সাধারণের সঙ্গে থাকতে ভালবাসত৷ ওর ওই পৃথিবীতেও যেন ওর শ্রেণিবদল না হয়৷ আসলে কালিকার মতো মানুষ যখন চলে যায়, তখন চলে যেতে দিতে হয়৷ আর ও তো সব সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখেই গিয়েছে৷ এমনকী ওর যাওয়ার পর কী গান বাজবে, সেটাও ও আগে তৈরি করে রেখে গিয়েছে৷ নিজের এপিটাফ লেখার মতো করেই ও সব করে রেখে গিয়েছে৷ শুধু ও চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পৃথিবী থেকে অনেক গান চলে গেল৷ সে তো আর কখনও ফিরে পাওয়ার নয়৷
লোপামুদ্রা মিত্র (সঙ্গীতশিল্পী)
আজ আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখলে একটাই কথা লিখব, ভাল থেকো কালিকা৷ ওকে মিস তো করছিই, প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই৷ আমার ব্যক্তিগত জীবনে বহু হোঁচট খাওয়ার মুহূর্ত যখন এসেছে, তখন কালীকা সামলে নিয়েছে৷ পাশে থেকেছে৷ অনেক সময় অনেক প্রশ্ন উঠত, এটা কী, ওটা কী… সব ও সামলে নিত৷ আজ সেখানে সেখানে আমার হোঁচট খাওয়া চলছে৷ আজ তো আর কালীকা নেই৷ লোকগানের অ্যাকাডেমি গড়ার স্বপ্ন ছিল ওর৷ দোহার সে কাজ করছে৷ আর ‘সহজ পরব’ করে যাচ্ছি, সেখানেও হোঁচট খাচ্ছি৷ আজ ওকে কী আর বলতে পারি! ভাল থাকুক যেখানেই থাকুক৷
সুতীর্থ দাশ (ক্রিয়েটিভ হেড, AMSI রেডিও নেটওয়ার্ক)
কালিকার সদা হাসিমুখ আমাকে অবাক করত৷ অনেক দিন একসঙ্গে চাকরি করেছি৷ আসলে কর্পোরেট মিটিংগুলি তো বেশ দমবন্ধকর হয়৷ সেখানেও কালিকা হাসিমুখে থাকত৷ হয়তো ওর কোনও বক্তব্য খারিজ হয়েছে৷ তবু কালিকার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়নি৷ আর কত বিষয় নিয়ে যে আমাদের আলোচনা হত তার ঠিক নেই৷ লোকগান নিয়ে কথা তো হতই৷ কিন্তু বাংলা-হিন্দি রেট্রো নিয়ে যে ওর কী আগ্রহ ছিল, তা শুধু বন্ধুরাই জানত৷ হিন্দি ছবির গানের ভিতর যে শ্যামাসংগীতের সুর বসে আছে, কিংবা আর ডি বর্মণের কম্পোপিজশন, এসব নিয়ে আমাদের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা হত৷ আর একটা বিষয়ে আমাদের মতের খুব মিল ছিল৷ আমরা চেয়েছিলাম, কলকাতায় একটা ফোক স্টেশন হোক৷ যেমন হিন্দি বা বাংলা গানের রেডিও স্টেশন আছে৷ লোকসুর, মাটির সুর যেভাবে বাংলা-হিন্দি গানে মিশে আছে, সেগুলো উঠে আসুক৷ কত আলোচনা যে করেছি সে সব নিয়ে৷ যন্ত্র সংগ্রহের বিষয়েও পাগল ছিল৷ ছত্তিশগড় থেকে একটা যন্ত্র নিয়ে এসে বলল, সুতীর্থদা, শুনে যাও৷ সেই ফোনগুলো আর আসে না৷ সেই আড্ডা-আলোচনার জায়গাগুলো নিয়েই ও চলে গিয়েছে৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.