প্রিয় পুজো প্যান্ডেলে কেউ আজও খুঁজে পান হারিয়ে যাওয়া মা-বাবা-ভাইকে। কারও মনে পড়ে জীবনের প্রথম হার্টব্রেক। নিজেদের প্রিয় পুজো নিয়ে নস্ট্যালজিক তারকারা। শুনলেন ইন্দ্রনীল রায়।
শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
প্রিয় পুজো: বরানগর শিব মন্দিরের পুজো
ওই জায়গাটায় মাটিটা একটু স্যাঁতসেঁতে থাকত, একটা লোহার গেট খুলে ঢুকতে হত। বিশ্বাস করুন, আজ এত বছর পরেও আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই পুজোটা। যা আমার কাছে ছোটবেলা থেকেই স্পেশাল। সেই সময় ওই অঞ্চলের পুরপিতা ছিলেন আমার বাবা। ওই শিব মন্দিরের সামনে একটা জলের পাম্প ছিল আর তার সঙ্গে লাগোয়া একটা ফলক, যাতে বাবার নামটা জ্বলজ্বল করত। ওই বয়সে বাবার নামটা দেখে কী যে গর্ব হত তা আজকের অনেক পাওয়ার পাশেও তা কিছু না। আমি আর দাদা রিকশা করে যেতাম। অন্য রিকশায় আমার দুই দিদি থাকত। ওখানেই আমার অঞ্জলি দেওয়া, ওখানেই আমার নতুন জুতো পরে পায়ে ফোসকা পড়া। আজ সাউথ কলকাতায় শিফট করে যাওয়ার পর আর ওখানে যাওয়া হয় না ঠিকই। কিন্তু আমার অঞ্জলিটা ওই বরানগর শিব মন্দিরের পুজোটাতেই থেকে গেছে।
[ ‘প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর মনোবিদের সাহায্য চেয়েছিলাম’ ]
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়
প্রিয় পুজো: পার্ক সার্কাস ময়দান
আমার বাবারা বাংলাদেশ থেকে এসে কলকাতায় থাকতে শুরু করেন ৯৫/২ কড়েয়া রোডে। তার পর বাড়িতে যখন আর জায়গায় কুলোয়নি, তখন বাবা গড়িয়া শিফট করে যান। অামি গড়িয়ায় সারা জীবন থাকলেও ছোটবেলা থেকেই কড়েয়া রোডের বাড়ির ওই জয়েন্ট ফ্যামিলির হইহুল্লোড়, দাদু-ঠাকুমা, আত্মীয়স্বজন- এই পরিবেশটা আমার কাছে ছিল বিরাট আকর্ষণের। এমনও হয়েছে, সপ্তাহে দু’দিন বাবা আমাকে, মা’কে আর দাদাকে ওখানে নামিয়ে দিয়ে কাজে বেরিয়ে গেছেন। যেহেতু ওই বাড়িটা পার্ক সার্কাসের কাছে, তাই পার্ক সার্কাস ময়দানের ওই পুজোটাই আজও আমার সবচেয়ে কাছের দুর্গাপুজো। এমনিতে ঠাকুর দেখার চল ছিল না আমার বাবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। কিন্তু পার্ক সার্কাসের পুজোটায় বাবা আমাদের নিয়ে যেতেন। সে দিন সব আবদারও মেটাতেন। রমেশ পালের মূর্তি, চারিদিকে চণ্ডীপাঠ চলছে মাইকে, স্ট্র দিয়ে ধীরে ধীরে কোকাকোলা খাচ্ছি, তার পর ভেলপুরি, আইসক্রিম- আজও যেন সিনেমার মতো সবটা দেখতে পাই। এই দিনটা দেখতাম মা যেন বেশি আনন্দ পেতেন। একটু বিহ্বল লাগত মা’কে। বড় হয়ে বুঝেছি, যেহেতু বাবা খুব একটা আমাদের নিয়ে বেড়ানোর সময় পেতেন না, তাই জন্যই হয়তো আমাদের সঙ্গে এই বেড়ানো, মা’কে জিনিসপত্র কিনে দেওয়ার মধ্যে মা হয়তো স্বামীর সেই ছবিটা দেখতে পেতেন যা তাঁর মনের ভাবনার সঙ্গে মিলে যেত। পরে যখন আমার ছেলে উজান হল, আমিও চূর্ণী আর পোলোকে (উজানের ডাকনাম) নিয়ে পার্ক সার্কাসের ঠাকুর দেখতে গেছি। আজ হয়তো আর নিয়মিত যাওয়া হয় না। কিন্তু বাবা যে ট্র্যাডিশনটা শুরু করেছিলেন, পুত্র হিসেবে হয়তো সেই আবর্তটা আমি কমপ্লিট করতে পেরেছি। পার্ক সার্কাস ময়দান। আমার প্রাণের পুজো।
[ কমবয়সি পার্টনার এখন নতুন ট্রেন্ড! কী বলছে নবীন প্রজন্ম? ]
শ্রীজাত
প্রিয় পুজো: বিধানপল্লিতে মামাবাড়ির পুজো
প্রত্যেকটি প্রাণের পুজোই বোধহয় খুব গভীর ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে উঠে আসা এক ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। এমন কিছু স্মৃতির আঁকড়ে থাকা যা মানুষকে সারা জীবন তাড়িয়ে তাড়িয়ে বেড়ায়। আমার মায়ের কাকার বাড়ি বিধানপল্লিতে। ওই বাড়িতেই আমার ছোটবেলার সব ক’টা পুজো কাটত। সারা বছর মাসতুতো ভাইবোনেরা সবাই যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম ওই চারটে দিনের জন্য। ছুটি পড়লেই একে একে সবাই মামার বাড়িতে হাজির। ওই চার দিন কোনও নিয়ম নেই। সকাল থেকে রাত অবধি হইহুল্লোড়, আড্ডা, প্রসাদ খাওয়া, নতুন জামাকাপড় পরা। ওই পুজোতেই আমার খুব কাছের এক ভাইয়ের সঙ্গে সারা দিন চলত আড্ডা। সেই আড্ডা কোনও ঘড়ি মানত না, আমাদের কথাও যেন শেষ হত না। ওর ডাকনাম ছিল জিজো, ভাল নাম প্রজ্ঞান। ও ছিল আমার প্রাণের মানুষ। আমাদের দু’জনের মধ্যে প্রত্যেক দিন সন্ধেবেলা ঢাক প্রতিযোগিতা চলত। সেই সময় কিন্তু কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলতাম না। ছোটবেলার সেই ট্র্যাডিশন ভালই চলছিল, আমি ততদিনে লেখালিখি শুরু করেছি, জিজো আর্মিতে যোগ দিয়েছে। কিন্তু পুজোর সময় আমরা মানিকজোড়। পুজো কাটিয়ে সে বছর আমরা সবাই নিজের নিজের বাড়ি ফিরে গেছি। আবার এক বছরের অপেক্ষা। এর মধ্যেই একদিন হঠাৎ খবর এল, আর্মিতে কর্মরত জিজো আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। যে মানুষটার জন্য আমার পুজোর যাবতীয় আনন্দ, যে মানুষটার সঙ্গে ঢাক বাজানো ছিল আমার জীবনের একটি অঙ্গ, সে কিনা আর নেই! জিজোর সঙ্গে দশ বছর আগে ওই ঢাক পেটানোই ছিল বিধানপল্লিতে আমার শেষ পুজো। তার পর আর ওই বাড়ির পুজোয় যাওয়ার সাহস হয়নি। আজও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই আরতি হচ্ছে একদিকে আর অন্য দিকে আমি আর জিজো ঢাক পেটাচ্ছি। আমার প্রাণের মানুষটি আর নেই। কিন্তু বিধানপল্লির মামার বাড়ির পুজোটা চিরজীবনের জন্য আমার প্রাণের পুজো হিসেবেই থেকে যাবে।
[ ঋতুপর্ণা, দেবশ্রীর থেকে কী উপহার চান? অকপট প্রসেনজিৎ ]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.