শহরের কিছু শব্দ, যা আজ নিরুদ্দেশ। রোমন্থনে সম্বিত বসু।
‘প্যায়াসা’ ছবির একটি দৃশ্য মনে করা যাক। জনি ওয়াকার মাথায় টুপি, কাঁধে গামছা, বগলদাবা করে রেখেছেন একটি কাঠের চেয়ার। স্থান: কলকাতা। মুখে ঘুরছে দুরন্ত এক গান, ‘তে-ই-ল মালিশ, তে-ই-ল মালিশ।’ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিরিওয়ালার এই গান অমরত্ব পেয়েছে। কিন্তু এই তেল মালিশের ডাক হারিয়ে গিয়েছে কলকাতার বুক থেকে। গত কুড়ি বছরে খাস কলকাতার বুকে এ রকম বেশ কিছু ডাক কমে গিয়েছে। হারিয়েও গিয়েছে। রইল তার কয়েকটি। ভাগ্য যদি সদয় হয়, আর কান যদি হেডফোনহীন হয়, তা হলে হয়তো এই শব্দগুলো কোনও একদিন একবারের জন্য হলেও শোনা যাবে।
ল্যান্ডলাইন
প্রথম যখন এসে পড়েছিল বাড়িতে, কী বিস্ময়! শ্যামবাজারের বড়মাসি কিনা এই ফোনের ভিতর ঢুকে ‘হ্যালো’ বলছে? মাঝে মাঝে পাশের বাড়ি থেকে নিভুনিভু দিদা এসে হাঁক, ‘একটা ফোন করা যাবে?’ হয়তো সেই ফোনে পাওয়া গেল না তাঁর ছেলেকে, পরে বুঝতে পেরে ছেলের প্রতিফোন। এবার সেই দিদাকে জানাতে গিয়ে পাড়া তোলপাড়। দু’তিনটে বাড়ি নিজেদের ভিতর খবর চালান করে দিচ্ছে, ‘ছেলে ১০ মিনিট পরে ফোন করছে, তুমি অমুক বাড়িতে যাও দিদা।’ ল্যান্ডলাইনের শব্দ এখন কমে গিয়েছে। সকলেই স্মার্টফোনে ব্যস্ত। ল্যান্ডলাইন এখন অনেকটা স্মারক। স্মৃতির ভিতর কত টেলিফোন নম্বর যে জমে রয়ে গিয়েছে তাও! দেখেছিলাম একটি দেওয়াল, ছবি ও অজস্র নম্বর লেখা, দেওয়াল রং হওয়ার আগে গৃহকর্তা টুকে রাখছেন। অনবরত ক্রিং শব্দ দূরের গ্রহে বেজে চলেছে আজ।
[ ‘সুচিত্রাদির সঙ্গে সম্পর্ক খুব স্পেশ্যাল’, লেখিকার জন্মদিনে নস্ট্যালজিক ঋতুপর্ণা ]
ধুনুরি
শীত পড়ার অল্প আগেই দেখা যেত ধুনুরিওয়ালাদের। বাড়ির সামনে বড় বারান্দা থাকলে আলাদা কথা, নইলে ছাদে কাজ করতেন তাঁরা। ‘তুলোধোনা’ শব্দটা এসেছে ধুনুরি থেকেই। তুলো ধোনা এবং ধোনা তুলো থেকে লেপ, তোশক, বালিশ তৈরি হত আগে। বাঙালিকে উষ্ণতা দিতে বিহার থেকে চলে আসতেন এই ধুনুরিরা। ধুনুরি যন্ত্রটি দেখতে অনেকটা বাদ্যযন্ত্রের মতো। খাস রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, ‘নিশ্চয় এমন মহৎ লোক আছেন সব যন্ত্রেই যাঁদের সুর বাজে, এমনকী তুলোধোনা যন্ত্রেও।’ এ বছরের ‘সাহিত্য অকাদেমি’ পুরস্কারপ্রাপ্ত সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ধুনুরির আওয়াজটিকে লিখেছিলেন এইভাবে: ধুনুরি। ধনুকে টংকার। থং থুং শব্দ। সঙ্গে সহকারী। তুলোর বস্তা। নানারকমের কাপড়। টকটকে লাল শালু। কিন্তু সেই ধুনুরিরা কোথায় উবে গেল সব? রেডিমেড কম্বল-বালাপোশের দেদার সাফল্যে তারা বেপাত্তা। সরু গলির ভিতর শিল্পী একটি বাদ্যযন্ত্র কাঁধে হয়তো এখনও অপেক্ষা করছে তার শ্রোতার জন্য। এই কলকাতা তাঁর দেখা পাচ্ছে না।
টাইপ মেশিন
খটাখট খটখট। খটাখট খটখট। ঢ্যাং। এই ‘ঢ্যাং’ শব্দটার জন্যই ফারাক কম্পিউটার আর টাইপ মেশিনের। ওই ‘ঢ্যাং’-এর অর্থ পাতার বাঁ দিক থেকে আবার শুরু হতে চলেছে লেখা। লিখতে লিখতে পাতার একেবারে ডান দিকে চলে এসেছিল। একটা সময় কলকাতার বাজারে টাইপ জেনে রাখলে কাজ প্রায় পাকা ধরে নেওয়া হত। সেই কলকাতায় আজ টাইপরাইটারদের কেবলমাত্র কোর্টপাড়াগুলোতেই দেখতে পাওয়া যায়। ১৯৯৮ সালের ‘ওয়াজুদ’ ছবিটির কথা এক্ষেত্রে না বলে পারছি না। নানা পাটেকর এই ছবিতে বিভিন্ন সময়ে আঙুল দিয়ে টাইপ মেশিনের শব্দ নকল করতে থাকেন। জানতে চাইলে যা বলেন, তার তর্জমা করলে দাঁড়ায়- এই আওয়াজটা চলতে থাকলে মনে হয় বাবা আমার সঙ্গে রয়েছেন। আওয়াজটা বন্ধ হয়ে গেলে ঘাবড়ে যাব আমি। ছোটবেলা থেকে আমার কান এই আওয়াজের শুনেছে। এটাই আমার কাছে ঘুমপাড়ানি গান।
চড়ুইপাখি
চড়াইপাখি এক্কাদোক্কা খেলে না আর। চড়ুইভাতিও হয় না। হয় ‘পিকনিক’। তাদের নিরন্তর কিচিরমিচিরের দিকে তাকিয়ে দু’দশ মিনিট অন্য একটা জীবনে প্রবেশ করা যেত। যে জীবন দোয়েলের, ফড়িংয়ের। গত কয়েক বছর ধরেই তাদের জোরালো কিচিরমিচির তো গিয়েছেই, এমনকী, সুখী গৃহস্থর চিহ্ন এই ছোট্ট পাখিটি প্রায় বিদায় নিয়েছে। সুখী মানুষের হাতে মোবাইল, বাইরে রেডিয়েশন। এই রেডিয়েশনই দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে চড়াইপাখিদের। সে কোন এক্কাদোক্কার দ্বীপ, কোন নিরাপদ বাসভূমি- গুগ্ল ম্যাপও তার কোনও টের পাবে না।
চাবিওয়ালা
ঝনঝন করতে করতে তার চলে যাওয়াই ছিল বাতিক। হাজার হাজার চাবি সারা গায়ে। গায়ে-হাতে দারিদ্র লেগে থাকলেও, সে স্বল্প চেষ্টাতেই রাজার ঘরের গুপ্তধনটিকে বের করে দিতে পারে। হারানো চাবি, ভাঙা চাবির ছাপ নিয়ে সে আসলে ম্যাজিশিয়ান। ইদানীং তাদের দেখা যায় না সেভাবে। দুপুরের তালা ভেঙে বিকেলের পথ ধরে চাবিওয়ালা যে কোথায় চলে গেল! শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘আমার কাছে এখনো পড়ে আছে / তোমার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া চাবি/ কেমন করে তোরঙ্গ আজ খোলো!’ এই তোরঙ্গ বাস্তবে খোলার জন্য দরকার যে চাবিওয়ালার, সে আজকাল আর রাস্তা দিয়ে শব্দ করে যায় না। অবান্তর স্মৃতির ভিতর কি পড়ে নেই চাবিওয়ালাও?
ব্যান্ডপার্টি
নব্বইয়ের শেষেও সন্ধেবেলা পাড়ায় পাড়ায় শোনা যেত ব্যান্ড প্র্যাকটিস। দেশাত্মবোধক গান বাজানো চলত একটানা। একজন লিড করছে বাকি সবাইকে। সে সময় শোনা যেত লাইভ এই ইনস্ট্রুমেন্টাল। ড্রামস্টিক, বাঁশি নিয়ে ‘কদম কদম বড়ায়ে যা’ করতে করতে একদল ইউনিফর্ম পরা লোক রাস্তা জ্যামজমাট করে ফেলত। সেই রেওয়াজের চল এখন আর নেই যে, তা বলাই বাহুল্য। পুজোর বিসর্জন এলে তবু মনে হয়, কোথা থেকে এলেন তাঁরা? কোন গোপন কক্ষে চলছে তাঁদের নিবিড় প্র্যাকটিস? ক্যালেন্ডারের পাতা কি তা হলে বড় দ্রুত ছিঁড়ে ফেললাম আমরা?
[ ‘বাস্তব নিয়ে রানির কোনও ধারণাই নেই’, বললেন ক্ষুদ্ধ রেচেল ]
ঝিঁঝি
ক্রিকেট মানে ঝিঁঝি এবং তা দাপুটে হলেও ঝিঁঝির ডাক এই কলকাতা থেকে উবে গিয়েছে প্রায়। বাড়ির পিছনের গাছটিতে একটা অদ্ভুত সুর রিনরিন করত গোটা দশ বছর আগেও। বাড়ির জ্যেষ্ঠজন কি সেই গাছের কাছে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে দেখতে পেতেন না তাঁর গ্রাম? সেই গাছই তাঁর কাছে কল্পতরু। ফেলে আসা জমি, ধানখেত। হতে পারে সে গ্রাম কলকাতা থেকে দূরে, কিংবা এসে পড়ছেন এপারে দেশভাগের ফলে। ওই ঝিঁঝি ছাড়া তাঁর স্বদেশে ফিরে যাওয়ার আর কোনও উপায় ছিল না। সেই ঝিঁঝিদেশ, দেশের জাতীয় সংগীত আর নেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.