কিশোর ঘোষ: প্রতিবাদের সঙ্গে গানের সম্পর্ক কতটা ধারাল, তার সহজ উদাহরণ সত্যজিতের কালজয়ী ছবি ‘হীরক রাজার দেশে’। “দেখো ভালো মানুষ রইল অনাহারে/ মন্দ যে জন সিংহাসনে চড়ে”, এ গান শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন হীরক রাজা। এ তো গেলো সিনেমা। বাস্তবের মাটিতে সেই কবে বাঙালি হেঁটেছিল বঙ্গভঙ্গের বিরোধী আন্দোলনে। প্রতিবাদী গান বেঁধেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। স্বদেশিরা মন্ত্রের মতো করে মিছিলে মিছিলে গেয়ে উঠেছিল—“বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান!” ১৯০৫-এর মতোই ১২০ বছর পর ২০২৪-এ আর জি কাণ্ডের প্রতিবাদে বাঙালির কণ্ঠে ফিরল রবীন্দ্রসঙ্গীত। অবশ্য একা রবি ঠাকুর নন, মেয়েদের রাত দখল থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে, জুনিয়র চিকিৎসক-সহ সর্বস্তরের মানুষের মিটিং, মিছিলে ‘পুনর্জন্ম’ হয়েছে বিদ্রোহী কবি নজরুলেরও। এর পরেও চমক রয়েছে। কারণ আজকের প্রতিবাদী কণ্ঠে রবীন্দ্র-নজরুলকে ছাপিয়ে যাচ্ছেন বাঙালির সঙ্গীত দুনিয়ার আরেক কিংবদন্তি সলিল চৌধুরী। একাধিক গানে গানে তিনি যেন ‘সন্ধ্যার ধ্রুবতারা’!
গত ৮ আগস্ট রাতে আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা ঘটে। জঘন্য অপরাধের বিচার চেয়ে শুরু হয় আন্দোলন। রাত দখলের ডাক দেন মেয়েরা। এর পরই প্রতিবাদের সুনামি আছড়ে পড়ে গোটা বাংলায়। যার কাণ্ডারি হন জুনিয়র চিকিৎসকরা। শুরু হয় মিছিল, মিটিং, ধরনা। চিকিৎসকদের পাশাপাশি অভিনেতা, সঙ্গীতশিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাকর্মী, সাধারণ পড়ুয়া মায় সর্বস্তরের মানুষ পথে নামেন। সকলের দাবি এক— “উই ওয়ান্ট জাস্টিস”। বাঙালির এই প্রতিবাদের ভাষ্যে সমকালীন সঙ্গীত নয়, বরং বহু যুগের ওপাড় থেকে ফিরলেন আধুনিক বাঙালি সংস্কৃতির দুই হোতা রবীন্দ্র-নজরুল। ধর্মতলা থেকে ধুলাগড়, বরানগর থেকে বারাসত, যাদবপুরে থেকে কোচবিহার, সবখানে প্রতিবাদী মিছিলের আয়ুধ হয়ে উঠেছে “এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে/ জয় মা বলে ভাসা তরী” কিংবা “আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো/ ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো” এবং অবশ্যই “একলা চলো”। আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে ‘রাজনৈতিক’ হোক বা ‘অরাজনৈতিক’, সমস্ত মিছিলে রবীন্দ্রনাথের একাধিক গান শোনা গেলেও নজরুলের ‘পুনর্জন্ম’ প্রধানত ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটিতেই। যদিও বিদ্রোহী কবির একাধিক আগুন জ্বালানো পংক্তি স্লোগান হচ্ছে মিছিলে মিছিলে। তবে কিনা সলিল চৌধুরী যে এভাবে উচ্চারিত হবেন, তা হয়তো ঘটনা ঘটার আগে অনেকেই ভাবতে পারেননি।
অনেকেরই ধারণা ছিল, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বামেরা যেমন, সেভাবেই ব্যান্ড জমানো ডিঙোনো সময়ে সলিল চৌধুরীর গান ‘ব্যাকডেটেড’ হয়ে গিয়েছে। সেই ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করল সাম্প্রতিক প্রতিবাদ আন্দোলন। বাংলার পথে পথে মানুষের মুখে বেজে উঠছে— “আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিবাদের আগুন”, ধরনা মঞ্চের মাইকের দাবি— “পথেই এবার নামো সাথী/ পথেই পবে পথ চেনা”। একই সময়ে শহরের অন্য প্রান্তের মিছিল সমস্বরে গেয়ে উঠছে— “ঢেউ উঠছে কারা টুটছে আলো ফুটছে প্রাণ জাগছে”। একজন শিল্পীর জন্য এর চেয়ে বড় উত্তরণ আর কী-ই বা হতে পারে। বলা বাহুল্য, এই ঘটনা সৃষ্টির কালজয়ের হাতেগরম প্রমাণ। কারণ, আন্দোলনকারী মাত্রই জানেন, গাছের যে কারণে আলো লাগে, প্রতিবাদ মিছিলের সেই কারণে লাগে যুতসই গান। স্বর্ণযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার, গায়ক সলিল চৌধুরীর গান আজ সেই কাজই করে চলেছে। গান থেকেই বেরোচ্ছে অদৃশ্য গুলি। যে বুলেটে বিদ্ধ হচ্ছে প্রশাসন।
চলতি প্রতিবাদের ঢেউয়ে অল্প হলেও ভেসে উঠছেন অন্য শিল্পীরা। হেমাঙ্গ বিশ্বাস থেকে প্রতুল মুখোপাধ্যায়, বাংলায় প্রতিবাদের গানের তো অভাব নেই। কোনওকালে ছিল না। ইতিমধ্যে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে গান বেঁধেছেন অরিজিৎ সিং। শিল্পীর নিজের শহর জিয়াগঞ্জের মিছিলে প্রতিবাদীদের কণ্ঠে শোনা গিয়েছে—“এই ব্যথা আমার নয় শুধু একার/ বিপ্লবী তিলোত্তমা করেছে অঙ্গীকার”। ‘কবে আর’ গানটি অরিজিতেরই লেখা ও সুর করা, গেয়েছেন তো বটেই। অন্যদিকে নয়ের দশকের কবি সন্দীপন চক্রবর্তীর প্রতিবাদী কবিতা থেকে গান বেঁধেছেন তরুণ সঙ্গীত শিল্পী অর্ক মুখোপাধ্যায়। যদিও বাঙালির প্রতিবাদের প্রধান ভাষ্যদাতা সেই রবীন্দ্র-নজরুল। ‘পুনর্জন্মে’ দাপট দেখাচ্ছেন সলিল চৌধুরীও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.