কিশোর ঘোষ: সেকালে তবলা ছিল পাড়াতুতো রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর রোগা সঙ্গতকার। অবশ্যি দুই জনপ্রিয় শিল্পীর অনুষ্ঠানের মাঝে ‘তবলা লহরা’র রেওয়াজ ছিল রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায়। মূলত ফাঁকা চেয়ার ও শতরঞ্চি ছিল যার মুগ্ধ-দর্শক শ্রোতা। বাড়িতে ছেলেপক্ষ এলেও তবলচির ডাক পড়ত। আমজনতার কাছে যন্ত্রসঙ্গীতের দুনিয়ার দুয়োরানি সেই তবলাকে নয়ের দশকে রাতারাতি ভূভারতে গ্ল্যামারাস করে তুলেছিলেন তিনি। পণ্ডিত জাকির হুসেন। ঝাঁকড়া চুল। পাঞ্জাবি-পাজামা। তাজমহল চা। মিষ্টি বোল তুলতে ডাইনা-বাঁয়ায় হাত না বিদ্যুত ছুটত কে জানে! বাচ্চা-বুড়ো সব্বাই টেলিভিশনের ভাষায় বলে উঠত, ‘বাহ উস্তাদ!’ তরুণীরা প্রেমে পড়তেন। তাঁর ধ্রুপদী ঘরানা, কিংবদন্তী শিল্পী বাবা আল্লা রাখার কথা তখনও জানা নেই সাধারণ শ্রোতার। এমন মানুষের চলে যাওয়া এক বিরাট শূন্যতা। কেবল ধ্রুপদী সঙ্গীতের জগতেই নয়, সেই ভারতীয়র কাছেও, যিনি হয়তো বা মূলত জনপ্রিয় ফিল্মি সঙ্গীত শুনেই জীবন তরী বাইছেন। তবু জাকির হুসেনকে শুনেছেন!
তবলাবাদক, সুরকার, সঙ্গীতজ্ঞ জাকির আল্লা রাখা কুরেশির জন্ম ১৯৫১ সালের ৯ মার্চ। কিংবদন্তি তবলাবাদক আল্লা রাখার জেষ্ঠ সন্তান তিনি। মাত্র তিন বছর বয়স থেকেই তবলায় তালিম নেওয়া শুরু। প্রথমবার সাত বছর বয়সে মঞ্চে একক অনুষ্ঠান করেন। ২২ বছর বয়সে ১৯৭৩ সালে বিটলস খ্যাত জর্জ হ্যারিসনের মিউজিক অ্যালবাম ‘লিভিং ইন দ্য মেটেরিয়াল ওয়ার্লড-এ সঙ্গত করেন। শুধু হ্যারিসনই নয়, সঙ্গীত জীবনের শুরুতেই ভ্যান মরিসনের মতো শিল্পীর সঙ্গেও কাজ করেছেন জাকির। তবলায় সঙ্গত করেছেন পন্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ আমজাদ আলি খানদের মতো দিকপালেদের।
নিজের প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তবলাবাদক তো বটেই, এছাড়াও একাধিক ভূমিকায় দেখা গিয়েছে উস্তাদকে। একদিকে আল্লা রাখার পুত্র হিসেবে ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন যেমন, তেমনই হ্যারিসন, মরিসনের মতো শিল্পীদের সঙ্গে তালবাদ্যের নানা আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছেন। কাজের সুবাদে কম বয়সেই হয়ে উঠেছিলেন আন্তর্জাতিক শিল্পী। চলচ্চিত্রের জন্য সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সুরসৃষ্টি করেছেন। মালায়লাম ছবি ‘বনপ্রস্থম’-এর সঙ্গীত তৈরির পাশাপাশি অভিনয়ও করেন জাকির। ছবিটি কানে-সহ একাধিক চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মানিত হয়। বিশ্বখ্যাত পরিচালক ইসামাইল মার্চেন্টের একাধিক ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় উস্তাদ।
অনেকেই মনে করেন, জাকির মানুষের মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন তাঁর সৌম্যকান্তি চেহারা এবং সদা হাস্যময় ব্যক্তিত্বের জন্যও। সবচেয়ে বড় কথা, ক্যামেরার সামনেও ছিলেন সপ্রতিভ। ‘জাকির হুসেন অ্যান্ড হিস ফ্রেন্ডস’, ‘দ্য স্পিকিং হ্যান্ডে’র মতো একাধিক তথ্যচিত্র যার সাক্ষী। অন্যদিকে শিল্পীর তালের জাদুতে মুগ্ধ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাকা ওবামার মতো ব্যক্তিত্বও। ২০১৬ সালে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে ‘অল স্টার জ্যাজ গ্লোবাল কনসার্টে’ অংশ নেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে নৃত্যশিল্পী অ্যান্টনিয়া মিনেকোলার সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। অন্তোনিয়া তাঁর ম্যানেজারও ছিলেন। দুই সন্তানের পিতা জাকির।
এ হেন উস্তাদের জন্য পুরস্কারের বন্যা বইবে সেটাই তো স্বাভাবিক, হয়েছেও তাই। ভারত সরকারের পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। পেয়েছেন সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি মতো পুরস্কার। ২০০৯ ও ২০২৪ দুবার গ্র্যামি পুরস্কার ভূষিত শিল্পী। এভাবেই বারবার বিশ্বমঞ্চে গর্বিত করেছেন ভারতের ধ্রুপদী সঙ্গীতকলাকে। এবং নয়ের দশকে তাঁর আগমনেই পাড়াতুতো রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর সঙ্গী রোগা সঙ্গতকারের গায়ে একটু-আদ্দু মাংস লাগতে শুরু করে। কবির সুমনও এড়াতে পারেননি আমজনতার মাঝে তাঁর আশ্চর্য উপস্থিতি। লিখে ফেলেন-তুই হাততালি দিলে জাকির হোসেন/ তবলা বাজানো ছেড়ে পায়রা পোষেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.