বয়স নিয়ে সমালোচনা৷ আবির চট্টোপাধ্যায় থেকে অরিন্দম শীল৷ নতুন করে ফেলুদায় ফেরত আসার স্পষ্ট জবাব৷ এবং ‘ডবল ফেলুদা’৷ পাঁচ বিষয়ে ধারাল মন্তব্যে সব্যসাচী চক্রবর্তী বুঝিয়ে দিলেন ভবিষ্যতে তিনিই আবার ফেলুদা৷ শুনলেন কোয়েল মুখোপাধ্যায়৷
ভয়ে-ভয়ে ছিলাম৷ বয়স হয়ে গিয়েছে তো! সো আই ডিসাইডেড টু টেক এ ব্রেক৷ আমি-ই বাবুদাকে (সন্দীপ রায়) বলেছিলাম, কমবয়সি কাউকে নিন৷ তখন আবির (চট্টোপাধ্যায়)কে নেওয়া হল ‘বাদশাহী আংটি’ ছবিতে৷ কিন্তু বাবুদা চাইছিলেন না যে আবির ‘ব্যোমকেশ’ও করুক, আবার ‘ফেলুদা’ও করুক৷ এখন আবিরকে ‘ব্যোমকেশ’টা করতেই হবে৷ কারণ ও কনট্র্যাক্ট-বাউন্ড৷ তাই, ফাইনালি আমাকে বললেন, তোমাকেই ফেলু মিত্তির হতে হবে৷ আমি তো আবার ভয় পেয়ে গেলাম৷ বুড়ো বয়সে আমাকে ‘ফেলুদা’ হিসাবে বড় পর্দায় ভাল লাগবে তো? কিন্তু বাবুদা বললেন, তুমি তো আর টিকিট কেটে নিজেকে পর্দায় দেখবে না৷ দর্শক দেখবে৷ তাঁরা চাইছেন তোমাকে দেখতে৷ কথাটায় যথেষ্ট যুক্তি ছিল৷ তাই, ফেলুদা হিসাবে কামব্যাক করে খুব আনন্দ পেয়েছি৷
এবার আমার ‘হ্যাঁ’ বলার পিছনে তিনটে কারণ ছিল৷ প্রথমত, ছবিটার সঙ্গে বাবুদার সম্মান জড়িয়ে আছে৷ আমি যদি না বলতাম, তাহলে বাবুদা আর ফেলুদা করতেন না৷ দ্বিতীয়ত, সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাক, এটা ফেলুদার ‘ফ্যান’ হিসাবে আমি মেনে নিতে পারিনি৷ এতে, স্রষ্টাকে অসম্মান করা হত৷ তৃতীয়ত, যে অগুনতি দর্শক ফেলুদার ছবি দেখার জন্য বসে আছে, ফেলুদা না করলে তাঁদের বঞ্চিত করা হত৷
আবার সুযোগ পেলে আলবাত করব৷ যদি না অ্যাক্সিডেণ্টে পা দু’টো ভেঙে বসি৷
জটায়ু (সন্তোষ দত্ত) মারা যাওয়ার পর আর ফেলুদা করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন সৌমিত্রবাবু৷ কিন্তু ফেলুদাকে নিয়ে যখন টেলিভিশন সিরিজ হল, ওঁকে অভিনয় করতে হয়েছিল৷ কারণ, সত্যজিৎ রায় নিজে ওঁকে অনুরোধ করেছিলেন৷ আমাকেও সন্দীপ রায় বলেছেন বলেই আমি ফেলুদা করছি৷ আমার মনে হয়, এই চরিত্রটা আমার বদলে অন্য কারও হাতে গেলে ওটার বারোটা বেজে যাবে৷ কারণ তখন তাঁর হাতে ল্যাপটপ, সেলফোন চলে আসবে৷ যেমন শার্লক হোমসকে অতি আধুনিক করে দেওয়া হয়েছে৷ সেক্ষেত্রে সেটা অন্য ফেলু হয়ে যাবে৷ যা ঠিক নয়৷
আবিরকে ছোট না করেই বলছি, সাধারণ দর্শকও বুঝতে পারছিল না, ও আসলে ‘ব্যোমকেশ’ না ‘ফেলুদা’৷‘বাদশাহী আংটি’ দেখে অনেকে অনেক রকম প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল৷ কেউ বলেছিল, ওই ফেলুদার ওই তোপসে হয় না৷ কেউ বলেছিল, আবিরকে গোয়েন্দা মনেই হয়নি৷ এটাও শুনেছিলাম যে, খুব নরম-সরম গোছের লেগেছে৷ গোয়েন্দাগিরিটা ঠিক হয়ে ওঠেনি৷ আমার মনে হয়েছিল, হবে কী করে! ফেলুদা তো তখন ব্যাঙ্কে চাকরি করে৷ গোয়েন্দাগিরি তো সে শুরুই করেনি৷ কিন্তু এটা ঘটনা যে, আবিরের ফেলুদা অবতারে ছবিটা থেকে যে ধরনের দর্শক প্রতিক্রিয়া আমি আশা করেছিলাম, তা হয়নি৷ যতটা সাফল্য পাবে, ভেবেছিলাম, পায়নি৷
‘বাদশাহী আংটি’ ছবিতে অচেনা অভিনেতাদের দরকার ছিল৷ ওই ছবির পর যখন ফেলুদা খুঁজছিলেন বাবুদা, আমি নিজে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের ছবি ওঁর কাছে পাঠিয়েছিলাম৷ অনির্বাণের অভিনয়ের ক্লিপ পাঠিয়েছিলাম৷ বলেছিলাম, ‘প্লিজ কনসিডার হিম’৷ আবিরকে নিয়ে যখন আর ফেলুদা করা যাচ্ছে না, তখন অনির্বাণের কথা ভাবা যেতেই পারে, এটা আমি বাবুদাকে বলেছিলাম৷ কিন্তু বাবুদা একটু বয়স্ক, পরিণত ফেলুদা চাইছিলেন৷ অনির্বাণকে খুব কমবয়সি লাগছিল৷
জানি, পর্দায় আমাকে বয়স্ক লাগতে পারে৷ মানানসই না লাগতে পারে৷ কিন্তু এটুকু বলব, অভিনয়ের ক্ষেত্রে আমি কিন্তু কোনও খামতি রাখিনি৷ আর ফেলুদা এখন বেঁচে থাকলে তাঁর যা বয়স হত, সেই তুলনায় আমি তো ছোট৷ হ্যাঁ, ইন্ডাস্ট্রিতে রাইভ্যালরি থাকবেই৷ ও নিয়ে আমি চিন্তিত নই৷
দাম্ভিক মন্তব্য৷ দ্যাট’স হিজ ক্যারেকটার৷ কোনও হার্ম নেই তাতে৷ তবে, আমি মনে করি, শেষ কথা বলবে দর্শক৷ পাশাপাশি এ-ও চাইব, দু’টো ছবিই যাতে ভাল চলে৷
শশী কাপুরকে নিয়ে সত্যজিৎ রায় ফেলুদা করেছিলেন হিন্দিতে৷ ছবিটা ভাল রেসপন্সও পেয়েছিল৷ কিন্তু অল-ইন্ডিয়া লেভেলে৷ বাংলায় একেবারেই সাড়া ফেলতে পারেনি৷ বাঙালিরা ফেলুদার হিন্দি ভার্সান গ্রহণ করেননি৷ কিন্তু যদি এবার ফেলুদাকে নিয়ে হিন্দিতে ছবি করা হয়, হোক না৷ তাতে অসুবিধার কিছু নেই৷ ফেলুদারই ফ্যান-ফলোয়িং বাড়বে৷ তবে যেটুকু আমি জানি, সেটা হল সন্দীপ রায় কপিরাইট দিয়েছেন সোনার কেল্লার স্টোরিলাইনের৷ তার চরিত্রগুলোর নয়৷ ফেলু, তোপসে, লালমোহনের মতো তিনটে লোক গল্পে থাকতেই পারে৷ কিন্তু এই নামের কোনও লোক গল্পে থাকবে না৷
সৌমিত্রবাবুকে দেখেই ‘ফেলুদা’ করতে অনুপ্রাণিত হয়েছি৷ আমার চোখে ফেলুদাকে নিয়ে তৈরি হওয়া সেরা ছবি ‘সোনার কেল্লা’৷ সব সময় এক নম্বরে৷ ২৭ বার দেখেছি৷ সৌমিত্রবাবুই সেরা ফেলুদা৷ সৌমিত্রবাবুকে ৭.৫, নিজেকে দেব ৫.৫-৬, আবিরকে ৪.৫৷
ফেলুদাকে নিয়ে ছবি বানানোর অফার পেলে ‘হ্যাঁ’ বলার প্রশ্ন নেই৷ কারণ, আমি কোনওদিন পরিচালক হব না৷ ওই কাজটা খুব কঠিন৷ আমার দ্বারা হবে না৷ আমার মনে হয়, পরিচালনায় আসতে গেলে যে মেন্টালিটি দরকার, সেটা আমার নেই৷ আমি খুব অধৈর্য৷ খুঁতখুঁতে৷ পছন্দমতো না হলেই আমি বলে বসব ‘প্যাক আপ’৷ ব্যস, সব বন্ধ৷ এই রকম মানসিকতা নিয়ে কোনও প্রোডিউসারের টাকা নষ্ট করতে আমি পারব না৷ ঘর ঝাঁট দিতে পারব৷ সেটটা পরিষ্কার, ঝকঝকে করে দিতে পারব৷ কিন্তু ডিরেক্টর হব না৷
‘ডবল ফেলুদা’ ছবিতে গৌরবের (ছেলে) অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন বাবুদা৷ বলেছেন, ওঁর অভিনয়ের ফ্যান উনি৷ আমার তো মনে হয়, ফেলুদা চরিত্রে আমাকে ফিরিয়ে এনে আমাকেও ওঁর তরফ থেকে সবচেয়ে বড় কমপ্লিমেণ্টটা দিয়ে দিয়েছেন বাবুদা৷
বড়পর্দায় এসেছে ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’, ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’, ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’, ‘গোরস্থানে সাবধান’ এবং ‘টিনটোরেটোর যিশু’৷ ছোট পর্দায় দশটা গল্প করেছি৷ মঞ্চে ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করেছি৷ এবার ‘ডবল ফেলুদা’য় করেছি আরও দু’টো৷ সমাদ্দারের চাবি আর গোলকধাম রহস্য৷ হয়ে গেল আঠেরোটা৷ফেভারিট বাছা মুশকিল৷ তবে আলাদা করে বলব ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে’-র কথা৷
‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’র প্রথম সপ্তাহের কালেকশন বাংলা ছবির ইতিহাসে একটা রেকর্ড৷ জানি না, এখনও অক্ষত আছে কি না৷ তার পর ব্যোমকেশ এল৷ শবর এল৷ কিরীটী এল৷ ফেলুদা কিন্তু রয়েই গিয়েছে৷ আমার চোখে গোয়েন্দা গল্প হিসাবে ফেলুদার গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি৷ আট থেকে আশি, সকলে মিলে দেখতে পারে৷ অন্যগুলিতে কখনও কখনও অ্যাডাল্ট কনটেণ্ট এসেছে৷
ফেলুদার মতো ক্রিকেট খেলতে, বেড়াতে যেতে, কড়াপাকের সন্দেশ খেতে, চানাচুর দিয়ে চা খেতে ভালবাসি৷ ফেলুদার মতো গুনগুন করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাই৷ খয়ের ছাড়া মিঠে পাতার পান খাই৷ কিন্তু ওঁর মতো মগজাস্ত্র? না সেটি আমার নেই৷
ছবি – অরিজিৎ সাহা
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.