গঙ্গার ধারে তিনতলা বাড়ি। প্রত্যেক তলায় চলছে গানবাজনার তালিম। রবীন্দ্রসংগীত, বিলাবল, তবলা-গিটারের যুগলবন্দি। পুরো বাড়িটা যেন মিউজিক্যাল ইনস্টিটিউট। নৈহাটির এই বাড়িরই বাসিন্দা রাঘব চট্টোপাধ্যায়। গায়কের সঙ্গে আড্ডায় শ্যামশ্রী সাহা।
অনেক ওজন ঝরিয়েছেন। অভিনয়ে আসছেন নাকি?
না না। এটা শুধুই নিজের জন্য। এখন খুব হালকা লাগে। অনেক কাজ করতে পারি।
জায়গাটা খুব সুন্দর। রোম্যান্টিকও। এই জন্যই কলকাতায় ফ্ল্যাট নেননি?
একদম। প্রেমের জন্যও পারফেক্ট। এখানে আমরা কয়েক পুরুষ ধরে আছি। এই জায়গা ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে থাকার কথা, বাবা-মাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না।
পুরনো প্রেমও আছে? যাকে ছেড়ে যাওয়া যাচ্ছে না?
এই না না। তেমন কিছু না। আরে বলুন না। প্রেমিকার কথা বললে বিয়ে এখন ভাঙবে না।
সে রকম কিছু নেই। তবে কম বয়সে দু’একটা ক্রাশ সবার থাকে (হাসি)।
কখনও ভোরবেলা রেওয়াজ করতে গঙ্গার ধারে এসেছেন? এই মাঠে ফুটবল খেলার সময় পান?
হ্যাঁ। এখনও আসি। এখানে গান, খেলা সবই হয়।
১৫ আগস্ট ইউটিউবে আপনার সিঙ্গলস ‘বন্দেমাতরম’ রিলিজ হল। রেসপন্স কেমন? আপনার দুই মেয়েও তো ছিল, সপরিবারে কামব্যাক?
হ্যাঁ। বলতে পার। ‘বন্দেমাতরম’-এর রেসপন্স ভীষণ ভাল। দু’দিনে ষাট হাজার ভিউ ছাড়িয়েছে। আমার দুই মেয়ে কোরাসে আছে। পরের ভিডিও খুব তাড়াতাড়ি আসবে।
ভিডিওতে কী গান থাকবে?
‘চতুরঙ্গে রাঘব’, এই নামে আমার একটা জুক-বক্স আসছে। যেখানে আমি চারটে গান গেয়েছি। চারটেই ট্র্যাডিশনাল গান। একটা তো ১৫ আগস্ট ইউটিউবে এসেছে। একটা রবীন্দ্রসংগীত, একটা নিধুবাবুর টপ্পা আর একটা বাংলাদেশের ট্র্যাডিশনাল ফোক। এর মধ্যে দু’টো গানের ভিডিও হবে।
একটা সময় স্টেজে, অ্যালবামে দাপিয়ে বেড়াতেন। মাঝখানে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন?
এখন ছবিতে গান অনেক কমে গেছে। তাই সুযোগ কম। লিপে গান অনেক দিন বন্ধ।
এখন ক’টা গান মানুষের মুখে মুখে ফেরে? ক’টা গান পাড়ার প্যান্ডেলে শোনা যায়?
গানের সংখ্যা কমছে কিন্তু গানগুলো তো জনপ্রিয় হচ্ছে। দেখো আমি তো পাবলিক ডিল করি। এই গানগুলো কিন্তু শহরকেন্দ্রিক। কিছু নির্দিষ্ট মানুষ শুনছে। সে ভাবে গানগুলো পপুলার হচ্ছে না। এত গানের মধ্যে দু’টো পপুলার হচ্ছে। এটা তো কোনও রেশিও না।
এই সময়ের বাংলা ছবিতে আপনার গান নেই কেন?
এখন অনেক নতুন ছেলেমেয়ে এসেছে, তারা গাইছে।
সে তো আসবেই। তাদের জন্য নিজের জায়গা ছেড়ে দেবেন?
আমি তো ছেড়ে দিচ্ছি না। আমি বেসিক গানই বেশি গাইতাম। এই সময়ের বাংলা ছবিতে কেন আমার গান নেই, জানি না। সবার সঙ্গেই আমার ভাল সম্পর্ক। সবাই আমার দক্ষতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কলকাতাতেও আমি দেবুদার (দেবজ্যোতি মিশ্র) সঙ্গে, ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তর সঙ্গে অনেক কাজ করেছি।
[৭ দিন বন্ধ থাকতেই তোলপাড় রাজ্য, কেন সিরিয়াল এত জনপ্রিয়?]
এক সময় ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তর সুরে আপনার অনেক গান ছিল। এখন নেই কেন?
হ্যাঁ। ওর কম্পোজিশন আমার দারুণ লাগত। কখনও আমিও কম্পোজ করতাম। আমরা দারুণ সব গান করেছি। পরে ও ছবির গান নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এখন ওর সঙ্গে কাজ নেই। মনে হয় ও এখন যে গান বানাচ্ছে হয়তো সেটা আমার সঙ্গে যাচ্ছে না।
এত দিনের জুটি ভেঙে গেলে খারাপ লাগে। আপনারও নিশ্চয়ই লেগেছে?
খারাপ তো লাগবেই। আমার মেজর সব অ্যালবামে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি।
মুম্বই ছাড়লেন কেন?
আমি একটু বেশি বয়সে গান গাওয়া শুরু করেছি। তার আগে গিটার বাজাতাম। মুম্বইতে আমার এন্ট্রিটা দারুণ ছিল। কিন্তু তখন কলকাতায় আমার কেরিয়ার অনেক স্ট্রং। পরপর আমার অ্যালবাম বেরোচ্ছে, হিট হচ্ছে। প্রচুর শো। তার পর আমার ফ্যামিলি হল, মেয়ে হল। দায়িত্ব বেড়ে গেল। ওখানে থাকব বলে একটা ফ্ল্যাটও নিয়েছিলাম। মুম্বই এমন একটা জায়গা যেখানে একটা গান হিট হওয়া মানে এই নয় যে আগামী পঞ্চাশটা ছবিতে তুমি কাজ পাবেই। এ দিকে কলকাতায় তখন প্রচুর শো, অনেক কাজ। ওখানে থাকতে গিয়ে আমি শো মিস করছিলাম। আবার অনেকে বলতে শুরু করল রাঘব তো এখানে থাকেই না। এটা আমার শো-কে এফেক্ট করছিল। মুম্বইয়ে থাকলে এখানকার কাজগুলো মিস হয়ে যেত। তাই মুম্বই ছাড়লাম।
মুম্বইয়ে এখন অনেক বাঙালি মিউজিক ডিরেক্টর কাজ করছেন। সেখানে আপনি সুযোগ পাচ্ছেন না কেন?
আমি জিতের দু’টো ছবিতে গান গেয়েছি, ‘বন্ধন’ আর ‘শুভদৃষ্টি’। দু’টো গানই দারুণ হিট। জানি না কেন আর ও ডাকল না। শান্তনুদার (মৈত্র) কাছে আমি খুব কৃতজ্ঞ। মুম্বইয়ে প্রথম বিজ্ঞাপনের কাজগুলো শান্তনুদার সঙ্গেই করতাম। প্রীতমের (চক্রবর্তী) সিরিয়ালের টাইটেল সং গেয়েছি, বিজ্ঞাপনে গেয়েছি, কিন্তু তার পর আর ডাকল না। এ ছাড়া অনেক কিছুই আছে। কিছুটা লেগ পুলিং। একটা মফস্বলের ছেলে এসে শহরের অনেক ছেলেকে সরিয়ে গান গাইছে, এটা অনেকের গায়ে লাগত, সেটা বুঝতাম।
তারা কারা?
কারও নাম করতে চাই না। তবে আমি কখনও কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি। জানি যে কাজটা আমার পাওয়ার আমি পাব। যেটা আমার পাওয়ার নয়, সেটা কেউ এনে দিতে পারবে না। ট্রিক করে বা অন্যকে সরিয়ে নিজের জায়গা করে নিতে পারব না। ঠিকঠাক পিআর ও করতে পারি না। আমি যখন পাড়ায় আড্ডা মারছি তখন আর একজন হয়তো প্রোডিউসারকে সময় দিচ্ছে। তারা বেশি কাজ পাচ্ছে।
একটা প্ল্যাটফর্ম না থাকলে অন্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হয়। লাইমলাইটে থাকার জন্য বারবার মুখ দেখানোটা খুব জরুরি। না হলে সবাই ভুলে যায়। এটা আপনি মানেন?
হ্যাঁ। আমি তো থামিনি। কাজ করে চলেছি। ‘সা রে গা মা পা’য় জাজ ছিলাম। এখনও টিভি শোয়ে গেস্ট জাজ হিসাবে যাই। আগের চেয়ে দেশে-বিদেশে এখন আমার শো আরও বেড়েছে। সব সময় লাইমলাইটে থাকতে হবে সেটা আমি মনে করি না।
রূপঙ্কর-রাঘব এই দুটো নামই একটা সময় ছিল। কিন্তু রূপঙ্কর আপনার থেকে অনেকটা এগিয়ে গেলেন।
রূপঙ্কর সিনেমায় অ্যাকসেস বেশি পেয়েছে, তাই অনেকটা এগিয়ে গেছে। ওর গানের গলা বা গায়কি হিরোর ইমেজের সঙ্গে বেশি যায়। আমার সিঙ্গিং স্টাইলটা পিওর ক্ল্যাসিকাল, আবার ফোকও। তাছাড়া আমি মুম্বই নিয়ে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়ায় একটা গ্যাপ হয়ে গিয়েছিল। হয়তো আমি দু-চার বছর গাইছি না, কিন্তু একটা সময় তো গেয়েছি। আমার কাছে ছবির গানের এত সুযোগ আসেনি। এটা আমার ভাগ্য।
[নচিকেতা, রূপঙ্করদের আড্ডা ছিল শ্যামবাজারের এই চায়ের দোকানে]
এই যে একটা গ্যাপ। ফ্রাস্ট্রেশন হয়?
না না, আমার ব্যস্ততা একেবারেই কমেনি। আমার স্টেজ শো ছাড়াও নানা রকমের রেকর্ডিংয়ের কাজ থাকে।
আপনার কি মনে হয় ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকতে কোথাও একটা নাড়া বাঁধা দরকার?
আমি বিশ্বাস করি না। এটা যদি সত্যি হয়, তা হলে সেটা করতে পারব না। বড় ব্যানারের সঙ্গে ওঠাবসা করলে সেখান থেকে কিছু কাজ পাব। এর বেশি কিছু নয়। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের যুগে মানুষের কাছে পৌঁছানো সহজ, বেসিক গান দিয়ে শুরু করেছি, বেসিক গান নিয়েই এগিয়ে যাব। আমাকে অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে। গড়িয়াহাট, শ্যামবাজার, ধর্মতলা সব জায়গায় নিজের ক্যাসেট, সিডি নিয়ে ঘুরেছি। রিকোয়েস্ট করেছি, দাদা আমার সিডিটা একটু চালাবেন? বলেছি, একটু পুশ সেল করবেন। কোনও কিছুই সহজে পাইনি। একটা কথা বলতে চাই। আমার একটা খুব কষ্টের জায়গা আছে। আমি অনেক গান কম্পোজ করে রেখেছি। কিছু রিলিজ করেছি, কিছু করব। আমি চাই একটু ভাল ব্যানারের ছবিতে মিউজিক বানাতে। অনেকে আমার কম্পোজিশন শুনতে চেয়েছেন। আমি ছবির গানে কম্পোজার হিসাবে নতুন, তাই সুযোগ পেতে একটু সময় লাগবে। কিন্তু এটা আমার ডিরেক্টর-প্রোডিউসারদের কাছে অনুরোধ- প্লিজ আমার সঙ্গে বসুন। আমাকে মিউজিক বানানোর দায়িত্ব দিন। আমার কম্পোজিশন ছবিতে ব্যবহার হলে মানুষের ভাল লাগবেই।
(কথা বলতে বলতে গঙ্গার ধার থেকে রাঘবের বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু। অনেকেই জিজ্ঞেস করলেন, “রাঘবদা ভাল আছো?” এক রাজমিস্ত্রি কাজ ফেলে সামনে এসে বলল, “রাঘবদা, হাউ আর ইউ?” রাঘব মজা করে বললেন, “ভাল আই আ্যম।”)
পাড়ায় তো আপনি সবার কাছের মানুষ?
হ্যাঁ। এরা সবাই আমায় এত ভালবাসে, তাই তো এই জায়গা ছেড়ে যেতে পারি না।
ইলেকশনে দাঁড়ালে এই সিটটা আপনার পাকা।
হ্যাঁ, আমার কাছে দুটো বড় রাজনৈতিক দলের অফার আছে।
কোন দল?
সেটা বলব না। আমি ইন্টারেস্টেড নই। রাজনীতি বুঝি না। গানপাগল লোক। আমি সংগীত নিয়ে বাঁচতে চাই, সংগীত নিয়েই মরতে চাই।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
[‘আমার জগৎ সাধারণ মানুষ নিয়ে, যাঁদের কোনও বডিগার্ড নেই’]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.