নির্মল ধর: বাবা ও ছেলের সম্পর্কের এমন গভীর সংকট ও স্পর্শকাতরতা নিয়ে আগে কোনও বাংলা সিনেমা হয়েছে বলে তো মনে পড়ছে না। স্মৃতিভ্রংশে আক্রান্ত চরিত্র আমরা দেখেছি সত্যজিৎ রায়ের ‘শাখা প্রশাখা’ ছবিতে। সেই চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন এই বাংলার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আবারও তেমন একটি চরিত্রে তিনি অভিনয় করলেন অতনু ঘোষের ‘ময়ূরাক্ষী’ ছবিতে। পাশে রইলেন তাঁর আত্মজর চরিত্রে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। প্রবাসী ছেলে বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে অল্প ক’দিনের ছুটি নিয়ে চলে এসেছে। তাঁর ধারণা ছিল বাবাকে ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করে দিয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়ে ওঠার নয়। ছেলে বুঝতে পারে বাবার অসুস্থতার পেছনে রয়েছে মানসিক কারণও। তিনি পঁচিশ বছর আগের ছাত্রী ‘ময়ূরাক্ষী’কে ভুলতে পারেননি। যাঁর সঙ্গে নিজের ছেলের বিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। বাস্তবে তো তা হয়নি!
[জন্মদিনে ‘শেপ অফ ইউ’ ঠুমকা সলমনের, ভাইরাল ভিডিও]
ছেলের জীবনেও অনেক জোয়ার-ভাঁটা। তাঁর দু’টো বিয়েই টেকেনি। কিন্তু বিয়ে ভাঙার আর্থিক খেসারত দিতে হচ্ছে একার আয়ে। তার ওপর রয়েছে অসুস্থ বাবার দায়িত্ব। বাবা-ছেলের মুখোমুখি হওয়া থেকেই ছবির পর্দায় ভঙ্গুর মুহূর্তগুলো ভাঙা টুকরো কাঁচের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। দর্শক দু’জনের ব্যথা-যন্ত্রণায় শরিক হতে থাকেন। ছেলের অসহনীয় ও অব্যক্ত ব্যথা যেমন উপলব্ধির গভীরে পৌঁছে দেয়, তেমনি অসুস্থ বাবার অসহায় পরিস্থিতির প্রতি সমবেদনাও জাগিয়ে দেয়। এবং কলকাতায় ছেলের স্বল্পকালীন অবস্থান বেশ মসৃণভাবে চিত্রনাট্যে অতনু ঘোষ বুনে দেন দু’টি চরিত্রের মোলায়েম ও মনোরম অতীতে। স্কুলের পুরনো বান্ধবীর (ইন্দ্রাণী হালদার) সঙ্গে আর্যনীলের খোলামেলা আলাপচারিতা যেমন থাকে, তেমনি নিজের হৃদয় খুঁড়ে বেদনার জায়গাগুলোও সে দেখায়, জানিয়ে দেয় বান্ধবীকে। কিংবা বাবার স্মৃতিতে আটকে থাকা ‘ময়ূরাক্ষী’র সন্ধান করতে গিয়ে আরও এক কঠিন বাস্তবকে আবিষ্কার করে নিজেই বিস্মিত হয়ে যায়। সত্যিই তখন বিদেশ যাওয়া ছাড়া অন্য পথ থাকে না। তবে ফিরে যাওয়ার আগে বাবার স্মৃতি থেকে ‘ময়ূরাক্ষী’র পাতাটি উড়িয়ে দিয়ে যায় ছেলে।
[বিয়েটা কবে করছেন? মুখ খুললেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া]
বাবা-ছেলের সম্পর্কের জটিলতার সঙ্গে প্রায় একই গুরুত্ব দিয়ে অতনু বাবার কেয়ার গিভার বা হাউসকিপারের (সুদীপ্তা চক্রবর্তী) একটি মানবিক চেহারাও তুলে ধরেছেন। কখনও কখনও মনে হয় অসুস্থ মানুষটি কি তাঁর মধ্যেই ‘ময়ূরাক্ষী’কে খুঁজে পেতে চান? নইলে ছেলেও কীভাবে ওই হাউসকিপারের জিম্মায় বাবাকে রেখে প্রায় লুকিয়ে চলে যায় প্রবাসে! তাঁরও বিশ্বাসের গভীরে কোথাও ‘ময়ূরাক্ষী’-র পরিবর্ত ওই তরুণী।
এমন মন মোচড়ানো সিনেমা সত্যিই অনেকদিন দেখা যায়নি। নাচ-গানের কোনও জায়গাই নেই কাহিনিতে, গোয়েন্দাগিরির চোখও নেই কোথাও। ছবি জুড়ে শুধুই পরিচালক ও ক্যামেরাম্যানের (সৌমিক হালদার) গভীর দৃষ্টি দু’টি মানুষের উপর। ছবি চলতে থাকে মানবিকবোধ ও সংবেদনশীলতার মোড়কে। একই সঙ্গে দেবজ্যোতি মিশ্রের আবহ সংগীত প্রায় নীরব কান্নার মতো জড়িয়ে আছে ছবির শরীর জুড়ে। আর আগেই তো বলেছি, সৌমিত্র ও প্রসেনজিৎ জুটির প্রাণঢালা অভিনয় ‘ময়ূরাক্ষী’র প্রাণভোমরা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় আর ব্যবহার নিয়ে বাড়তি বিশেষণ আর কিছু নেই। প্রসেনজিৎও নিজেকে ভাঙচুর করে বুঝিয়ে দিলেন মনের মতো চরিত্র পেলে আজও অভিনয়ের জন্য তিনি কতটা ক্ষুধার্ত। সত্যিকার তিন সাবাশি তিনজনকেই!
[রিসেপশনের পরই অনুষ্কার জন্য খুশির খবর, জানেন কী?]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.