সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ‘লালবাতির নিষেধ ছিল না, তবু ঝড়ের বেগে ধাবমান কলকাতা শহর অতর্কিতে থেমে গেল।’ আক্ষরিত অর্থে চলমান তিলোত্তমা না থামলেও কলকাতাবাসীর আবেগকে স্তব্ধ করে দিয়ে ইহলোক ছেড়ে গেলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। আশ্চর্য সমাপতন বোধহয় একেই বলে। যে কবির লেখনি দিয়ে বেরিয়েছিল ‘কলকাতার যিশু’-র মতো কবিতা, সেই কবিই প্রয়াত হলেন যিশুর জন্মদিনে।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মতো কবি শতকে বোধহয় একজনই জন্মান। তিনি কবিতাকে ভালবাসতে শিখিয়েছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘শুধু কবিতার জন্য আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।’ আর নীরেন্দ্রনাথ শিখিয়েছিলেন কীভাবে কবিতাকে ভালবাসতে হয়। তাই তো তাঁর সময় থেকে বর্তমান কালের তরুণ কবি, সবার কাছেই তিনি আরধ্য। আজ, ২৫ ডিসেম্বর, যিশুর জন্মদিনে তাই যখন চলে গেলে ‘কলকাতার যিশু’, তখন শোকস্তব্ধ গোটা কলকাতার সংস্কৃতি মহল।
[ সাহিত্য জগতে নক্ষত্রপতন, প্রয়াত কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ]
কবির মৃত্যুতে শোকাহত লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “আমি এক আত্মীয়কে হারালাম।” কাজের খাতিরে আত্মীয়স্বজন ও পৈত্রিক বসতভিটে থেকে অনেক দূরে থাকেন তিনি। তাই কলকাতার সংস্কৃতি জগতের মানুষদেরই আপন করে নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যেই অন্যতম ছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। লেখক তো বটেই, লেখকপত্নীর সঙ্গেও ‘তুই তোকারির’ সম্পর্ক ছিল প্রয়াত কবির। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো মূহ্যমান কবি জয় গোস্বামীও। তিনি বলেছেন, কবির মৃত্যু বাংলা কবিতার জগতে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের পতন। যখন কোনও নতুন লেখা বের হত জয় গোস্বামীর, কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নিজেই ফোন করতেন। নিজের ভাললাগার কথা জানাতেন। তাঁর মৃত্যু সাহিত্য জগতে অপূরণীয় ক্ষতি।
সদ্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, টেবিলের একটা পায়া ভেঙে গেলে যেমন অবস্থা হয়, কবির মৃত্যুতে তেমনই অবস্থা তাঁর। ‘নীরেনদা’ তাঁকে বারবার ছোটদের জন্য লিখতে বলতেন। লিখতে না চাইলে জোর করে লেখাতেন। কবি নীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল দাদা-ভাইয়ের মতো। বরং বলা যায়, দাদার থেকেও অধিক ছিলেন প্রয়াত কবি। এতটাই ছিল তাঁর স্নেহ, ভালবাসা। যখন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখতে চাইতেন না, ঘুরে বেড়াতেন, কবি বলতেন “কাগজ কলম নিয়ে বসে যাও, দেখ কি হয়।” এভাবেই গড়ে ওঠে সম্পর্ক। তাঁরও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাই তো আজ লেখকের মনে হচ্ছে পরিবারের একজনকে হারিয়েছেন তিনি।
কবির মৃত্যুতে তরুণ লেখক ও কবিদের মধ্যেও নেমে এসেছে শোকের ছায়া। শ্রীজাত বলেছেন, কবিতার প্রতি তাঁর প্রেম জন্মায় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা পড়েই। কলম ধরার জন্য প্রথম বীজ তিনিই বপন করেছিলেন শ্রীজাতর অন্তরে। ছোটবেলায় তিনি একবার কবির সই নিতে তাঁর দপ্তরে গিয়েছিলেন। লেখার সূত্রে তারপরেও উভয়ের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়েছে। তিনি যখন আনন্দ পুরস্কার পেয়েছিলেন, তখন সেই শংসাপত্র লিখেছিলেন কবি নীরেন্দ্রনাথই। শ্রীজাতর বিয়েতেও এসেছিলেন। উপহার আনতে বারণ করা হয়েছিল বলে এনেছিলেন, তাঁর লেখা একটি বই। আজ সেই কথাগুলো বড় বেশি করে মনে পড়ছে বলে জানিয়েছেন শ্রীজাত। লেখিকা সংগীতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, কীভাবে বাংলা লিখতে হয়, তা কবির থেকেই শিখেছিলেন তিনি। বাংলা বানানকে তিনি নতুন এক দিশা দেখিয়েছিলেন।
[ দ্বিজেনবাবু মানেই মহালয়ার গান থেকে মাইকেলের সনেট… ]
জহুরি ছিলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। প্রতিভা তিনি খুঁটিয়ে বের করতেন। বড়দের জন্য যেমন লিখেছেন ‘নীল নির্জন’, ‘অন্ধকার বারান্দা’, ‘সময় বড় কম’, ‘ঘুমিয়ে পড়ার আগে’, ছোটদের জন্যও অনেক গল্প লিখেছেন তিনি। সাহস সবসময়ই তাঁর লেখনিতে থাকত। একাধিক কবিতায় তাই তিনি সমাজের অন্ধকার দিক তুলে আনতে পেরেছিলে। তাই তো সাহস করে লিখতে পেরেছিলেন, ‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.