চারুবাক: প্রায় বিশ পঁচিশ বছর আগে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় বানিয়েছিলেন ‘একটু উষ্ণতার জন্য’। তাঁর পনেরো বছর পর ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’। এবং গত বছর তৈরি ‘নগরকীর্তন’ এবছর মুক্তি পেল এবছর। তিনটি ছবিরই কেন্দ্রীয় থিম ‘অন্যরকম প্রেম’। বলা যায়, কৌশিক যেন এই ছবিতে নিজের নিরাপদ জোনে ফিরলেন। রাস্তা ঘাটে অতি সাধারণ নারীর পোশাকে কিছু ‘পুরুষ’-কে হাততালি দিয়ে খনখনে সুরে সোজা কথায় ভিক্ষা চাইতে দেখি। গাড়ির কাচে টোকা শুনে অনেক আরোহীই বিরক্ত হন। কেউ বা সমাজের জঞ্জাল হিজড়ের উপস্থিতি এড়িয়েই যান। এঁরা সবাই খেটে খাওয়া গরিব মানুষ। এঁদের নিজস্ব ঘেরাটোপে একটা সংসার আছে। যেখানে সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, ভালবাসা সব কিছুই মুলধারার মানুষের মতোই। কিন্তু আমাদের অধিকাংশের চোখেই তাঁরা ব্রাত্য, অস্পৃশ্য, প্রান্তিক।
কৌশিক এমনই সাধারণ ‘অন্য’ এবং ‘প্রান্তিক’ দুই মানুষের অন্তরের কথা ধরতে প্রয়াসী এই ‘নগরকীর্তন’ ছবিতে। শুরু থেকেই কৌশিক বিষয় নির্বাচনে দুঃসাহস, অভিনবত্ব দেখিয়ে আসছেন। এবারও ব্যতিক্রম ঘটল না। এক উঠতি বয়সের বৃহন্নলার (পরি) সঙ্গে স্বাভাবিক তরুণ মধুর প্রেমপর্বের সঙ্গে তিনি মিলিয়ে দিয়েছেন রাধাকৃষ্ণের অপূর্ণ প্রেম।
মধু নবদ্বীপবাসী এক কীর্তনীয়া পরিবারের ছেলে। তাদের জীবিকাই হল রাধাকৃষ্ণের গান গেয়ে বেড়ানো। বাঁশি বাজায় মধু। পারিবারিক পেশা ছেড়ে শহরে এসে মধু রেস্তরাঁর ডেলিভারি বয়ের কাজ নিলেও বাঁশি হাতছাড়া করেনি। হিন্দি সিনেমার চটুল গানের সুর এখন তাঁর বাঁশিতে। আর সেই বাঁশির টানেই পরি অর্থাৎ পুঁটি এসে পড়ে তার জীবনে। ভগবান পুঁটির শরীর বানাতে একটু ভুল করেছে। নারীর বদলে দিয়েছে পুরুষের শরীর। সে অবশ্য মধু পয়সা জোগাড় করে ‘সারিয়ে’ নেবে। সুতরাং প্রেমে বাধা ঘটেনি দু’জনের। এমনকী শারীরিক ঘনিষ্ঠতাতেও। পরির নকল চুলটাই তাঁর পছন্দ, কোঁকড়ানো আসলটা নয়। আর এখানেই কৌশিক নাটকের চূড়ান্ত পর্যায়টি লুকিয়ে রাখেন।
[ ‘গাল্লি বয়’-এর ব়্যাপে কতটা মজল দর্শক? ]
সাধারণ বৃহন্নলা জীবনের খুঁটিনাটি ডিটলেস-সহ তথ্যচিত্রকারের ভঙ্গিতে তুলে আনলেও পরির জীবনের সঙ্গে সুন্দর মিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। মধু পরির প্রেমের সামাজিক সংকটকেও সহমর্মিতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন কৌশিক। ডকুমেন্টেশনের ‘অ-প্রকৃত’ প্রেমের মানবিক দিকটার উপর জোর দিয়ে তিনি প্রায় অস্পৃশ্য করে রাখা গরির বৃহন্নলার সম্মানকে স্বাভাবিক ও প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এখানেই ‘নগরকীর্তন’ নবদ্বীপ ছাড়িয়ে নাগরিক হয়ে ওঠে। পরিচালক পুরো ছবিটাকেই গেঁথেছেন বর্তমান ও অতীতের দৃশ্যমালায়, ফ্ল্যাশব্যাকে। সুন্দর, সাবলীল তাঁর চিত্রনাট্যের সেলাই, কাঁথা সেলাইয়ের শাড়ির মতো ভারি বর্নিল ছবির ডিজাইন। ভাল লাগে নবদ্বীপের প্রায় অশিক্ষিত কীর্তনীয়া পরিবার কৃষ্ণের অন্যরূপ চৈতন্যকেও উপলব্ধি করতে না পেরে ছোটছেলের অসম প্রেমকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। কীর্তন তাদের কাছে শুধুই জীবিকা। জীবনের কোনও উপলব্ধি নয়। এই সংঘাতটি প্রায় নীরবেই বেরিয়ে আসে ছবির কাঠামো ছাড়িয়ে। ফ্ল্যাশব্যাকের টুকরো টুকরে খণ্ড দিয়ে পরির প্রত্যাখ্যাত প্রেমপর্বটিও ভারী সুন্দর করে সাজিয়েছেন পরিচালক। কীর্তনের সুর এবং গান (প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়) গল্পের গতি ও নাটককে আরও তীব্র করেছে। আর আছে অভিনয়। পরি চরিত্রে ঋদ্ধি সেন রূপসজ্জায়, পোশাকে তো বটেই, দারুণ অভিনয়েও অত্যন্ত সাবলীল এবং যন্ত্রনায় ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার সময়েও তাঁর অভিব্যক্তি বিস্ময় জাগায়। আর আছেন মধুর চরিত্রে ঋত্বিক চক্রবর্তী। তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা আর কী ভাষায় করব! ঋদ্ধি তবুও চিত্রনাট্যের ব্যাকিং পেয়েছেন। কিন্তু ঋত্বিক তো চলতি ভাষায় বিপরীত চরিত্র। দর্শকের সমবেদনা পাওয়ার জায়গা নেই। এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ঋত্বিক মধু চরিত্রের আত্মিক, পারিবারিক, সামাজিক সংকটের মুখোমুখি হয়েও মধুর প্রতি দর্শকের পজিটিভ ভাবনাকে সঞ্চার করতে পেরেছেন স্রেফ অভিনয়ের জোরে। কঠিন কাজটি তিনি সহজাত দক্ষতায় করেছেন।
‘নগরকীর্তন’ যেমন এই দুই অভিনেতা-শিল্পীর ছবি, তার চাইতে বেশি পরিচালক কৌশিকের ছবি। কারণ আগের দুটি ছবির অপূর্ণতা এবং খামতি তিনি অনেকটাই পূরণ করতে পেরেছেন। উচ্চবিত্তের বিলাসী দুঃখপনা সরিয়ে কৌশিক চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বৃহন্নলাদের স্বাভাবিক জীবনকে ধরেছেন। নিছক সমবেদনার দৃষ্টিতে নয়, মানবিক ভঙ্গিতেও ভরপুর ছবির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। ঋদ্ধি আর ঋত্বিকের পাশে দাঁড়িয়ে মানবী ও শংকর নামের বৃহন্নলা সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ‘শব্দ’ ও ‘ছোটদের ছবি’-র মতো এই ছবিও কৌশিকের ফিল্মোগ্রাফিতে একটি বর্ণাঢ্য রঙিন পালক বলতেই পারি। এই ছবি দেখার পর দর্শকের একাংশও যদি এড়িয়ে থাকা প্রান্তিক মানুষগুলোর প্রতি এতটুকু মানবিক হয়ে উঠতে পারেন, সেটাই হবে কৌশিকের জীবনের সেরা পুরস্কার। সমসাময়িক রাজনীতি থেকে তো দৃষ্টি সরিয়েইছেন টালিগঞ্জের মেরুদণ্ডহীন পরিচালকের দল, কৌশিক তবুও অরাজনৈতিক একটি সমস্যার দিকে আলো ফেললেন।
[ ‘ভবিষ্যতের ভূত’-দের কতটা চেনাতে পারলেন পরিচালক অনীক? ]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.