চারুবাক: দিনের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনযাপনের পর রাতে একান্তে কখনও কি শোওয়ার ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়াই আমরা কেউ? প্রতিফলিত ‘আমার’ দিকে তাকিয়ে নিজেকে কি কখনও কেউ প্রশ্ন করে দেখেছেন, দিনটা কেমন কাটল? সকালবেলা কাগজে এক আদিবাসী তরুণীকে গণধর্ষণের খবর নিয়ে অফিস ঘরে বা বাসে সহযাত্রীদের আলাপচারিতায় ‘সমাজটা গোল্লায় গেল’ বলে গলা ফাটিয়েছিলেন মনে পড়ছে? গৌরী লঙ্কেশের ঘুনের ঘটনাকে ‘শখের বিপ্লবীপনা’ বলে গাল পেড়েছিলেন, সেটা কি ভুলতে পেরেছেন? কিংবা এক নামী লেখকের পুরস্কারপ্রাপ্তিকে ‘আঁতেলদের গোষ্ঠীবাজি’ বলে নস্যাৎ করেছিলেন, সেটা ভুলে গিয়েছেন? আমাদের এমন বিস্মৃতি ও ভুলোপনাকে প্রায় ঝুঁটি ধরে পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় নিজেই আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন তাঁর নতুন ছবি ‘মুখোমুখি’-তে। আত্মম্ভরিতার মুখোশটা ছিঁড়ে দর্শকের হাতে প্রায় ধরিয়েই দিলেন বলতে পারি।
[ ‘এক লড়কি কো দেখা তো…’ ক্যায়সা লগা? জমাট বাঁধল প্রেমকাহিনি? ]
তাঁর ‘ক্ষত’ ছবির মতো এই ছবির প্রোটাগনিস্ট মাঝবয়সী লেখিকা। নাম ঈশা। রীতিমতো জনপ্রিয়, সফল এবং অত্যন্ত সচেতনভাবেই প্রান্তিক মানুষদের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতিশীল। ঈশা তাঁর নতুন উপন্যাসটি পড়ে শোনাচ্ছেন অবসর নেওয়া নাবিক অফিসার স্বামী অগ্নিভকে। এই পর্যন্ত ব্যাপারটা সরল। গল্প শোনানোর মধ্যেই উপন্যাসের প্রধান দুই চরিত্র শৌনক-অনসূয়া ঢুকে পড়ে সশরীরে। দুই পরিবারের ঘরের সেট একইরকম। ন্যূনতম। আলমারি, বইয়ের ব়্যাক মঞ্চের মতো ‘সাজানো’। বিছানা-বালিশ-খাট নিউজপ্রিন্টে ছাপা যেখানে গুগাবাবার লোগো থেকে কোকাকোলার বিজ্ঞাপনও ছড়িয়ে আছে। দোতলা যাওয়ার লাল সিঁড়িটা শূন্যে শেষ হয়েছে। প্রায় একই আসবাব ও প্রপসের মধ্যে দুই দম্পতির জীবন। ঈশার লেখার মধ্যে অগ্নিভর ইনপুটস ঢুকে পড়ে মাঝে মাঝে। গানের শিল্পী শৌনক এখন সংগ্রামী। স্ত্রী অনসূয়া সোজাসাপটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী ঘরোয়া গিন্নি। সুতরাং দু’জনের মধ্যে সম্পর্কের দেওয়ালটি ভাঙছে। ঠিক এমনই অবস্থায় ওই ঘরে ঢুকে পড়ে না রিয়েল, না ম্যাজিক চরিত্র অঞ্জন দত্ত। এই সর্বজ্ঞ মানুষটিই শৌনক-অনসূয়ার দাম্পত্যকে অন্য আলোয় দেখেন, দেখাতেও চান। বিশ্বের তাবড় সংকট-সমস্যা, মানুষের দৈনন্দিন দ্বিচারিতা, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় রাজনীতি, আত্মম্ভরিতার ফাঁপা বেলুনটিকে তিনি তর্কের পিন ফুটিয়ে ফুউ-উ-স করে দেন। আর তখনই আয়নার সামনে দর্শক নিজের অজান্তেই জন্মদিনের পোশাকে নিজেকে দেখতে পান। এখানেই ‘মুখোমুখি’-র সার্থকতা।
বাংলা সিনেমার চলতি ফর্মকে ভেঙে এক নতুন ফর্ম আনতে চেয়েছেন কমলেশ্বর। চরিত্রগুলোর ছটফটানির মতো ছবির ব্যকরণও ছটফট করেছে বিষয়ের অভিঘাতে। দেবজ্যোতি মিশ্রর অভাবনীয় আবহ এবং শ্রীভড়ের চিত্রগ্রহণ চার দেওয়ালের মধ্যেও রংয়ের বিন্যাসে এক মায়াময় পরিমণ্ডল তৈরি করে দেয়। অভিনয়ে গার্গী রায়চৌধুরী, রজতাভ দত্ত, যিশু সেনগুপ্ত, পায়েল সরকার; কারোরই খারাপ কাজের সুযোগ নেই। এঁরা সকলেই তো পরিচালকের হাতের পাপেট। এমন চিত্রনাট্যে এঁরা তো সেরাটুকুই দেবেন। দিয়েছেনও।
[ ঝাঁসির রানির মতোই শৌর্য, ‘মণিকর্ণিকা’-এ সফল উত্তরণ কঙ্গনার ]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.