শুভময় মণ্ডল: সমাজে অনেক শ্রেণির বাস। কেউ রাজা হয়, কেউ প্রজা, কেউ বা দাস আবার কেউ তারও নিচে। এদের প্রত্যেকের মধ্যে ব্যবধান বা দূরত্ব থাকা উচিত। নাহলে সবাই সমান হয়ে গেলে রাজা কে হবে? সত্যিই তো একজনকে তো ঊর্ধ্বে থাকতেই হবে, নাহলে সমাজতন্ত্রের মানে কী! আর যদি রাজাই না থাকে, তবে? এমনই প্রশ্ন তুলে দেশের সমাজব্যবস্থা কঙ্কালসার চেহারাটা তুলে ধরল অনুভব সিনহার ‘আর্টিকল ১৫’। ভারতের ভিতরে এক অন্য ভারত। শপিং মল, সিনেমা হল, বিনোদন পার্ক, আইপিএল, ঝাঁ-চকচকে রেস্তরাঁর ইন্ডিয়ার ভিতরের ভারতবর্ষ। যেখানে দৈনিক মজুরি ৩ টাকা বাড়ানোর অনুরোধ করায় তিন কিশোরীকে গণধর্ষণ করা হয়, তারপর তাদের মধ্যে দুজনকে খুন করে প্রকাশ্য গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। তাদের অপরাধ? নিচুজাতের মেয়ে হয়ে এত দুঃসাহস হয় কী করে, তাই উচ্চবর্ণের কয়েকজন একটা গোটা সম্প্রদায়কে শিক্ষা দিতে এমন নৃশংস ঘটনা ঘটায়। এমনই এক অস্বস্তিকর অথচ রূঢ় বাস্তবকে পর্দায় তুলে ধরেছেন পরিচালক অনুভব সিনহা। এবং এই প্রচেষ্টায় তিনি ফুল মার্কস পেয়েছেন বলাই যায়।
এক নির্ভীক আইপিএস অফিসারের ভূমিকায় ছবিতে অভিনয় করেছেন আয়ুষ্মান খুরানা। সেই ‘ভিকি ডোনার’ থেকেই বোঝা গিয়েছিল তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া। একের পর এক ছবিতে আরও বলিষ্ঠ হয়েছে তাঁর অভিনয়। এই ছবিতেও তার অন্যথা হয়নি। ছবির প্রেক্ষাপট উত্তরপ্রদেশের একটি ছোট শহর লালগাঁও। সেখানেই নিচুজাতের কিশোরীদের সঙ্গে পাশবিক অত্যাচারের ঘটনা ঘটে। তারই তদন্তভার বর্তায় আইপিএস অফিসার অয়ন রঞ্জনের উপর। স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও হিন্দিবলয়, বিশেষত উত্তরপ্রদেশ এখনও জাতপাতের রাজনীতি থেকে বেরতে পারেনি। তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ এই ছবিতে ফুটে উঠেছে। সেই রাজনীতির উর্ধ্বে গিয়ে ঘটনার তদন্ত করা রীতিমতো পাঁকে নেমে নালা পরিষ্কার করার সমান ছিল আইপিএস অফিসারের পক্ষে। যেখানে তাঁকে সিস্টেমের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, রাজনীতির সঙ্গে এমনকী জাতিপ্রথার মতো বর্বরতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে।
প্রথমদিকে এই লড়াইয়ে তাঁর অধস্তন পুলিশকর্মীরাও তাঁর পাশে থাকতে পারছিলেন না। কিন্তু নেতা এবং সমাজব্যবস্থার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাঁরাও এই স্বচ্ছতা অভিযানে নেমে পড়েন। শেষপর্যন্ত এই অসম লড়াইয়ে জয়ী হলেন বটে অয়ন রঞ্জন। কারণ, শ্রেণিবৈষম্যের জেরে খুন, গণধর্ষণের মতো সমাজের জঞ্জালকে পরিষ্কার করতে গেলে যে পাঁকে নামতেই হবে। তাতে গায়ে দাগ লাগার কথা উপেক্ষা করেই সমাজকে শোধরাতে হবে। কারণ, বিজ্ঞাপনেই তো বলে, ‘দাগ আচ্ছে হ্যায়’! ভাবুন তো, ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় বাস করছেন অথচ ম্যানহোল, নালা পরিষ্কারের জন্য এক শ্রেণির মানুষের উপরই নির্ভরশীল আমরা। তাঁরা যদি হরতাল ডাকে তখন কী হবে! নিজে ম্যানহোলে নামবেন তো? তেমনই এই অপরাধের ম্যানহোলে পুলিশকর্তাকে নামতে মানা করেন অধস্তন কর্মীরা। কিন্তু নিষেধ অগ্রাহ্য করে বিবেক, কর্তব্যের খাতিরে কাদায় নামেন ওই আইপিএস। অত্যাচারিত এই সমাজব্যবস্থার নোংরা রূপকে কটাক্ষ করে বলেন, এখানে কেউ হরিজন কেউ বহুজন। শুধু জন কেউ হতে পারছে না। তবেই হবে জনগণমন। কী সহজ অথচ গভীর উক্তি!
এ ছবি দেখতে দেখতে আপনার চোয়াল শক্ত হতে বাধ্য। নিজেকেই প্রশ্ন করবেন, এ কোন ভারতবর্ষ! একটা দেশের মধ্যেই যেন আরেকটা দেশ, যেখানে কারও নামের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ সে ব্রাহ্মণ না শূদ্র, কায়স্থ না রাজপুত। হিন্দিবলয়ে এমন অনেক গ্রামই আছে যেখানে অপরাধের বিচার হয় বর্ণের উপর ভিত্তি করে। বিচারের জন্য কার কাছে ছুটবেন? পুলিশ-প্রশাসন? উর্দিধারী পুলিশও তো গণধর্ষণে শামিল! ছবির একটা দৃশ্যে নিজের অধস্তন কর্মীদের কাছে প্রত্যেকের জাত নিয়ে ব্যাখ্যা শুনতে গিয়ে মাথাগরম করে ফেলেন পুলিশকর্তা। কিন্তু এটাই তো ঘোর বাস্তব এ দেশে। জাত-ধর্মই এখানে মানুষের পরিচিতি। এর থেকে কীভাবে বেরবে সমাজ! প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ভেঙে পড়ার মুহূর্তে প্রেমিকাকে পাশে পান পুলিশকর্তা। সেই দৃশ্যও খুব মর্মস্পর্শী।
এর আগে ‘মুলক’-এর মতো ছবিতে দেশে ইসলামোফোবিয়ার বাড়বাড়ন্তের মতো জ্বলন্ত সমস্যা তুলে ধরেছিলেন পরিচালক অনুভব সিনহা। ‘আর্টিকল ১৫’-এও নিপুণভাবে এক গভীর সমস্যাকে উত্থাপন করেছেন তিনি। তাঁর এই প্রচেষ্টায় তাঁকে যোগ্যসঙ্গত দিয়েছেন আয়ুষ্মান খুরানা-সহ অন্য কলাকুশলীরা। ছোট চরিত্রে সায়নী গুপ্তা, মনোজ পাহওয়া, মহম্মদ জিশান আয়ুব নজর কেড়েছেন। নিপুণ বুনটের চিত্রনাট্য, নেপথ্যসংগীতও যথাযথ। এই ছবি মুক্তির আগে কম ঝামেলা হয়নি। উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় ছবির বিষয় নিয়ে আপত্তি তোলে। পরশুরাম সেনা নামে একটি ক্ষত্রিয়দের সংগঠনও আপত্তি তোলে। ছবির মুক্তিও পিছিয়ে যায়। অবশেষে আজ, শুক্রবার মুক্তি পায় ছবি। তবে এছবি নিঃসন্দেহে জাতিপ্রথার মূলে কুঠারাঘাত। নতুন ভারতের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.