সোমনাথ লাহা: পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের চৌকাঠে পা ফেলার প্রভাতী সকাল মহালয়া। যেদিন গঙ্গার ঘাটে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে নিবেদিত হয় তর্পণ। অার তখনই অাকাশ-বাতাস কম্পিত হয় এক ব্যারিটোন ভয়েসে। সঙ্গে সমবেত কণ্ঠের মাতৃবন্দনা, ১৯২৯ থেকে অাজ পর্যন্ত যা মিশে রয়েছে বাঙালির অস্থি-মজ্জায়। রেডিওর সেই প্রভাতী অনুষ্ঠান পরিচিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নামে। যেটির রচয়িতা বাণীকুমার। সুরকার পঙ্কজকুমার মল্লিক এবং ভাষ্যপাঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
[ গ্রেট বেরিয়ার রিফের রহস্যের সন্ধানে গৌরব-ঋদ্ধিমা ]
কিন্তু ইতিহাস বলছে বাঙালি জীবনের সঙ্গে জড়িত এই অনুষ্ঠানকে অতি জনপ্রিয় করার জন্য ১৯৭৬-এ এই অনুষ্ঠানটির পরিবর্তন নিয়ে অাসার কথা ভেবেছিলেন তৎকালীন রেডিও কর্তাব্যক্তিরা। সেবার রেডিওতে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র পরিবর্তে শোনা গেল মা ‘দুর্গতিহারিণী’। যেখানে গান গাইলেন লতা মঙ্গেশকর। অাশা ভোঁসলে, মান্না দে’র মতো শিল্পীরা। এবং সম্পূর্ণ নতুনভাবে। রচয়িতা হিসাবে বাণীকুমার থাকলেও, তিনিও রচনায় পরিবর্তন করলেন। সুর করলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তবে সবচেয়ে বড় চমক ছিল ভাষ্যপাঠে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণর জায়গায় সেবার পাঠ করলেন বাংলার মহানায়ক উত্তমকুমার। এজন্য তিনি যে ভালরকম মহড়া দিয়েছিলেন তাই-ই নয়। শোনা যায়, বাড়িতে শিক্ষক রেখেছিলেন শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণ শেখার জন্য। তবে সিনেমায় উত্তম-হেমন্ত জুটি সফল হলেও বেতার অনুষ্ঠানটিতে তাঁরা চূড়ান্ত ব্যর্থ হন। শোনা যায় উত্তমকুমার নাকি শুরুতে এই পাঠ করার জন্য রাজি ছিলেন না। তিনি নাকি বীরেন্দ্রকৃষ্ণর সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করেছিলেন। তবে শেষমেশ সরকারি জোরাজুরিতে নাকি রাজি হন মহানায়ক। তবে শ্রোতারা এই অনুষ্ঠানটিকে চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণর জায়গায় মহানায়ককে তাঁরা মেনে নিতে পারেননি। সেই এক মহালয়াকে প্রত্যাখ্যান ও অার এক মহালয়াকে বুকে অাঁকড়ে ধরে থাকার গল্পই এবার উঠে অাসতে চলেছে পরিচালক সৌমিক সেনের ছবি ‘মহালয়া’-তে। প্রসঙ্গত ইতিমধ্যেই মাধুরী দীক্ষিত ও জুহি চাওলাকে নিয়ে বলিউডে ‘গুলাব গ্যাং’-এর মতো ছবি তৈরি করেছেন সৌমিক। এটিই তাঁর প্রথম বাংলা ছবি।
[ হিন্দুদের ভাবাবেগে আঘাত, এফআইআর দায়ের রবিনার বিরুদ্ধে ]
ছবিতে উত্তমকুমারের চরিত্রে রয়েছেন যিশু সেনগুপ্ত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-র ভূমিকায় দেখা যাবে শুভাশিস মুখোপাধ্যায়কে। পঙ্কজকুমার মল্লিকের চরিত্রে রয়েছেন শুভময় চট্টোপাধ্যায়। অন্যান্য চরিত্রে রয়েছেন রুদ্রনীল ঘোষ, কাঞ্চন মল্লিক, সপ্তর্ষি রায় ও অন্যান্য শিল্পীরা। তবে ছবির অন্যতম একটি বড় চমক প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। সূত্রের খবর, এই ছবিতে নাকি এমন একটি চরিত্রে অভিনয় করতে চলেছেন প্রসেনজিৎ, যা নাকি তিনি অাগে কোনওদিন করেননি। এখানেই শেষ নয়। সৌমিকের এই ছবিটি প্রযোজনা করছে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের প্রযোজনা সংস্থা ‘এন অাইডিয়াজ ক্রিয়েশনস অ্যান্ড প্রোডাকশনস’। সূত্র মারফত জানা গিয়েছে, সৌমিকের এই ছবিটি অাগে অন্য প্রযোজনা সংস্থার করার কথা থাকলেও যে কোনও কারণবশত তারা পিছিয়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত প্রযোজনার ব্যাটনটি নিজের কাঁধেই নিয়ে নিয়েছেন টলিউডের বুম্বাদা। ছবিতে উত্তমকুমারের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য নাকি বিশেষ প্রস্থেটিক মেক অাপ করার কথা রয়েছে যিশুর। ছবির শুটিং শুরু হবে এই মার্চ থেকেই। বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, ছবিতে রয়েছে উত্তমকুমারের মৃতু্যর দৃশ্যও। ছবিতে রেডিও সম্পর্কিত যে সমস্ত বিরল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে তার গবেষণায় এবং জোগাড়ে প্রধান ভূমিকা পালন করছেন স্বয়ং প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। বাঙালি প্রতি মহালয়ায় রেডিও অনুষ্ঠান মহিষাসুরমর্দিনী শোনে। এটা এশিয়ার লংগেস্ট রানিং রেডিও প্রোগ্রাম। হয়তো সারা পৃথিবীর লংগেস্ট রানিং রেডিও অনুষ্ঠান। অাজও এটি বাঙালির জীবনে অপরিহার্য। অার কিছু গল্প এমন রয়েছে যা হিন্দিতে বলা সম্ভব নয়। ‘মহালয়া’ এমনই একটি গল্প।
[ সংগীতের স্বার্থে রাজ্য আমাকে ব্যবহার করুক: কবীর সুমন ]
সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই পরিচালক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও পঙ্কজকুমার মল্লিকের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন ছবির বিষয়বস্তু নিয়ে। শোনা যাচ্ছে কনসেপ্টটি বেশ পছন্দ হয়েছে তঁাদের। তবে ছবিতে কোনওভাবেই যাতে উত্তমকুমারকে অশ্রদ্ধার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখানো না হয় সেই বিষয়টিও মাথার রাখছেন পরিচালক। গল্পটা হিউজ। কারণ এটা এমন একটা রেডিও প্রোগ্রাম যেটা প্রায় দীর্ঘসময় ধরে সারভাইভ করছে, তার একটা গ্লোবাল রেলিভ্যান্স রয়েছে। তবে দর্শক প্রত্যাশা প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, “ঠিক যা প্রত্যাশা করা হচ্ছে তার থেকে অন্য কিছুও দেখা যেতে পারে। অাসলে রেডিওর এই অনুষ্ঠান গল্পটা ধরিয়ে দেয়। দু’জন সত্তরোর্ধ্ব প্রৌঢ় মানুষের রেলিভ্যান্সের কাহিনি এটি।”
[ শুধু কালিকার জন্য…আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখলেন বন্ধুরা ]
তবে নস্টালজিয়ায় অাচ্ছন্ন বাঙালি যে অারও একবার বীরেন্দ্র-উত্তমের ‘মহালয়া’ যুদ্ধকে পর্দায় প্রত্যক্ষ করতে চাইবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই এখন শুরু অপেক্ষার পালা। ‘মহালয়া’-যে পুজোতেই অাসবে তা ধরে নেওয়া যেতেই পারে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.