বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: ছোটবেলায় দূরদর্শনে দেখেছি খবরের পরে প্রায় রোজই থাকত নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা। একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি দেখিয়ে বয়স, গড়ন ইত্যাদি গড়গড় করে বলে যেত। ছোট বাচ্চা, মাঝবয়সি, বয়স্ক– কেউ বাদ নেই। অবাক হয়ে ভাবতাম, ছোটরা হারিয়ে গেল না হয় বুঝলাম, কিন্তু বড়রা কীভাবে হারিয়ে যায়! তারা কি নিজেরা বাড়ি চিনে ফিরতে পারে না? তবে একটা বদ্ধমূল ধারণা কেমন আপনা থেকেই হয়ে গিয়েছিল, টিভিতে কিংবা খবরের কাগজে যাদের নিয়ে নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা করা হয়, তারা কোনও দিন আর বাড়ি ফেরে না। ছোটবেলায় আসলে হারানো প্রাপ্তির হিসেবটা ঠিক বুঝতাম না। তবে এখন বুঝতে পারি, এই জনসমুদ্রে একটা মানুষের হারিয়ে যাওয়া, নেই হয়ে যাওয়া যেন আমার নিশ্বাস নেওয়ার মতোই স্বাভাবিক ব্যাপার। সাধারণ মানুষের জীবনের যে আসলে কোনও দাম নেই, সেটা আরও একবার মনে পড়ে গেল অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরি পরিচালিত ছবি ‘লস্ট’ দেখতে দেখতে। জি ফাইভে ছবিটি সদ্য মুক্তি পেয়েছে। ‘লস্ট’ দেখতে দেখতে ছোটবেলার ‘নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা’ নিয়ে বিস্ময়বোধ মনে পড়ে নিজেকেই নির্বোধ মনে হচ্ছিল।
পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরিকে কুর্নিশ জানাতে হয়, তিনি এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং অবহেলিত বিষয় তাঁর ছবির মধ্য দিয়ে আরও একবার সামনে নিয়ে এলেন। এর আগে তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি ‘পিঙ্ক’-এও আমরা তাই দেখেছি। ‘লস্ট’ ছবির ভরকেন্দ্র সাংবাদিক ‘বিধি সাহানি’, অভিনয়ে ইয়ামি গৌতম। বিধি ক্রাইম রিপোর্টার। ঈশান ভারতী (তুষার পাণ্ডে) নামে এক দলিত থিয়েটার অ্যাক্টিভিস্ট নিখোঁজ হলে, বিধি অনুসন্ধান শুরু করে। প্রাথমিকভাবে মামুলি ঘটনা মনে হলেও, যত এগোয় বিধি বুঝতে পারে, ঘোলা জলে, পাঁকের মধ্যে নেমে পড়েছে সে। পুলিশ এবং প্রশাসন ছেলেটিকে ‘মাওবাদী’ তকমা দিয়ে গা ঝেড়ে ফেলতে চায়। স্থানীয় এক দাপুটে নেতা রঞ্জন বর্মনের (রাহুল খান্না) নাম বারবার জড়িয়ে যায় এই কেসের সঙ্গে। কারণ ঈশানের প্রাক্তন বান্ধবী অঙ্কিতা (পিয়া বাজপেয়ী) বর্তমানে এই নেতার সঙ্গিনী। বিধি যত এগোয়, তত বাধা পায়। বাড়ি ফিরে নিজের নানুর (পঙ্কজ কাপুর) সঙ্গে আলোচনা করে। খাওয়ার টেবিলে রাজনীতি, ক্রাইম, নকশাল আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে সাধারণ আলোচনাও হয়। একটা দৃশ্য মনে থেকে যায়, যেখানে নানু তার আমলে নকশাল আন্দোলনের কথা তোলে। তিনি বলেন, অনেক সময় যেটা ঠিক, যেটা করা উচিত, সেটা করা যায় না। তার চেয়ে বোধহয় মানুষের জীবন কিংবা অনুভূতির দাম বেশি। কিন্তু একজন সাংবাদিক কী করবে? তার কী করা উচিত? এমন নানা জরুরি প্রশ্ন তোলে এই ছবি।
কোথায় গেল ঈশান? যে কি না সফদর হাশমির অনুপ্রেরণায় পথনাটিকা করে বেড়াত প্রত্যন্ত অঞ্চলে! সমতার কথা বলত তার শিল্পের মধ্য দিয়ে। আমরা দেখি ঈশানের নিখোঁজ হওয়ার পর, তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর মৃতদেহ। কীভাবে মারা গিয়েছে, জানা যায় না। বিধি অসহায় দর্শক। অধস্তন পুলিশ কর্মীরাও যেন অসহায়। চাকরি বাঁচাতে অর্ডার পালন করছে শুধু! পুলিশ বনাম মাওবাদীর যুদ্ধে কে আসল ভিলেন– এর সোজা উত্তর দিতে চাননি পরিচালক। তার কারণ এই নয় যে, পক্ষ নেওয়া কঠিন। আসলে এই ২০২৩-এ এসে দাঁড়িয়ে কাউকেই ক্লিন চিট দেওয়া সম্ভব নয়। যে সময় নকশাল আন্দোলন শুরু হয়েছিল, দলে দলে যোগ দিয়েছিল শিক্ষিত যুবক, যুবতীরা– সেই আন্দোলন অনেক পথ ঘুরে, অনেক রাস্তা পেরিয়ে এখন এক জটিল অবস্থানে দাঁড়িয়ে। চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায় না কাউকেই, এবং কেন যায় না– সেই সূক্ষ্ম প্রশ্নটাও তুলেছেন পরিচালক। এবং একই সঙ্গে পুলিশ এবং প্রশাসনকে কাটাছেঁড়া করেছেন জোরালো আতশকাচের মধ্য দিয়ে। এই ছবির অনেক খামতি থাকলেও, সবটা হারিয়ে যায় না। আমরা যারা সাধারণ তারা বরাবরই ক্ষমতাবানদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে এসেছি। যেমন ঈশানের ক্ষেত্রে দেখি, অধস্তন পুলিশ কর্মীদের কিংবা বিধির ক্ষেত্রে দেখি। কিন্তু তাদেরই মধ্যে কখনও কখনও একটা মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। এই ঘুরে দাঁড়ানো আছে বলেই সবটা হারিয়ে যায় না। ‘লস্ট’ যেমন প্রশ্ন তোলে, তেমন ঘুরে দঁাড়ানোর কথাও বলে। ছবি দেখে মনে পড়ে যায় নাজিব, গৌরী লঙ্কেশ, কালবুর্গি, পানসারে কিংবা রিজওয়ানুর রহমান, বরুণ বিশ্বাসের কথা। নাহ! সরাসরি মিল নেই। কিন্তু এরা প্রত্যেকেই কিছু ক্ষমতাবানের অসুবিধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এদের কথা আমরা জানি, কিন্তু ঈশানের মতো কত মানুষ, নিরুদ্দেশ হয়ে যায় সেটা জানতেও পারি না। না জেনে স্বস্তিতে থাকি বলেই একটা অস্বস্তি তৈরি করবে ‘লস্ট’, সেটাই উদ্দেশ্য।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.