রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: ভার্জিনিয়া উলফ-এর একটি দারুণ উচ্চারণ মনে পড়ছে : জন ডানের কবিতা শুরু হয় আরোহণের শীর্ষে। ‘কাবেরী অন্তর্ধান’-এর টানটান কাহিনি ও অ্যাকশন শুরু হচ্ছে ক্লাইম্যাক্স-এর চূড়ান্ত বিন্দুতে। এবং এই রুদ্ধশ্বাস গতি ও টান বজায় থাকে শেষ পর্যন্ত। ছবিটি দেখতে হয় চেয়ারের কিনারে বসে। টায়ার পাংচার হয় ফিয়াট গাড়িটার। ছবির চাকা নিটোল দৌড়ে পৌঁছে যায় অবিস্মরণীয়, হৃদয় ও প্রত্যয় চূর্ণ-করা চুর্ণীতে এবং ক্যাথারসিসে– একেবারে নিখাদ গ্রিক ট্র্যাজেডির ‘দেনুমা’ ও ‘ক্যাথারসিস’! ‘কাবেরী অন্তর্ধান’ থ্রি-ইন-ওয়ান। এক, ভারত জুড়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী-ঘোষিত জরুরি অবস্থা। দুই, নকশাল আন্দোলনে সারা বাংলা জুড়ে তুমুল তোলপাড়। তিন, ছবির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটি পুরুষ অর্ঘ্য সেনের (প্রসেনজিৎ) সঙ্গে দুই নারী, নয়নতারা (চূর্ণী) এবং কাবেরীর (শ্রাবন্তী) অবৈধ প্রেম। দুই নারীই বিবাহিত। এবং তারা সম্পর্কে বউদি-ননদ। একজন চায় পুরুষটির শরীর। এবং পুরুষটিকে দিতেও চায় অকপট শরীর। অন্যজন চায় পুরুষটির মন।
যে-সব দৃশ্যে পুরুষটি মন খোলে, পিয়ানো-রোম্যান্টিকতায় সে মন বিধুর মধুর ধূসর। আর যে-দৃশ্যে প্রসেনজিৎ মুক্ত শরীরে বিছানায়, কে বলবে এই নায়ক যৌবন পেরিয়েছেন! একটি রাজনৈতিক ছবিতে যেভাবে পরিচালক গেঁথেছেন ব্যাপক রহস্যে ও প্রসারে দুই নারীর মন ও শরীর ও বিপ্রতীপ চরিত্রের আহ্বান, তার ফলে গড়ে উঠেছে ধ্রুপদী ট্র্যাজেডির বেদনা ও বিকাশ। প্রসেনজিতের অর্ঘ্য সেন এক শিল্পী যে ডুয়ার্সের নির্লিপ্ত আরণ্যক পরিবেশে ছাত্রছাত্রীদের আঁকা শেখায়। এবং যাপন করে তৃষ্ণার্ত অথচ সঙ্গহীন জীবন। পুলিশ অফিসার কৌশিক সেন উত্তরবঙ্গের নকশাল দমনে ব্রতী ও বিপর্যস্ত। তার স্ত্রী চূর্ণী (নয়নতারা) এবং বোন শ্রাবন্তী (কাবেরী)– ক্রমশ পড়ে প্রসেনজিৎ -অর্ঘ্য-র টানে। একজন মনের। অন্যজন শরীরের। শ্রাবন্তীর স্বামী অমিয় (অম্বরীশ) স্ত্রীর শরীরের চাহিদা সামলাতে পারে না। তার ওপর সে বেকার। চূর্ণীর (নয়নতারা) স্বামীর দাপট আছে যত, তত আবার নেই বোধ ও সংবেদ। ফলে পরিচালক কৌশিক পেয়েছেন তাঁর প্রতিভার প্রাঙ্গণ– নারী-পুরুষের সম্পর্ক। এবং কী অসামান্য বুননে তিনি বুনেছেন এই উপচে-পড়া শরীর মনের খেলা। যে দৃশ্যে দাদা কৌশিক সেন বাঘের মতন খুঁজছেন প্রসেনজিতের স্টুডিওতে বোন শ্রাবন্তীর নগ্ন ছবি– কৌশিকের সেই ব্যগ্র বেদনা দেখার মতো। একদিকে ব্যর্থ ক্রোধ। অন্যদিকে আদিম রিরংসা। আর মাঝখানে কম্পমান কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের নারী-পুরুষ সম্পর্কের অন্বেষী অমিতি! ছবির পর ছবিতে এই এষণার তাই শেষ নেই তাঁর। পুলিশ অফিসার কৌশিক সেনকে মরতে হয় তার বাড়িতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে। আর সেই দিনই বোন কাবেরী নিখোঁজ।
‘কাবেরী অন্তর্ধানে’র এক বছর পরে যখন নতুন করে শুরু হয় ছবির গল্প। এবং গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো সেই কাহিনির নিয়তি-নির্ধারিত উন্মোচন। যতক্ষণ না আমরা পৌঁছচ্ছি শেষ দৃশ্যের বহ্নিমান কসমিক অন্তহীনতায়। কাবেরীর অন্তর্ধান আমাদের দিয়ে গেল এক নির্লিপ্ত নিমগ্ন রহস্যময় এবং দুর্বার প্রসেনজিৎ-কে অপূর্ব অভিনয়ে। দিয়ে গেল চূর্ণী আর শ্রাবন্তীর বিপ্রতীপ বেদনা ও তৃষ্ণার দহিত প্রকাশ। এবং এই দুই চরিত্রের উদ্বেল উন্মোচন। এরই মধ্যে ধরা থাকল অমিয়র চরিত্রে অম্বরীশের অসহায় যাপনের আর্ত অপমান। কী অব্যর্থ সংরাগে ফুটিয়েছেন অম্বরীশ। সবশেষে পোড়খাওয়া, অতি-ধূর্ত, নাছোড়, প্রৌঢ়, কোহলাসক্ত গোকুল দেবনাথের চরিত্রে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিনয়ে। তিনিই তো সেই গোয়েন্দা যিনি খুনির নির্ভুল সন্ধান দেন পুলিশ অফিসার প্রতাপ সিং (ইন্দ্রনীল)-কে। এবং তিনিই তাঁর তুলনা হয়ে থাকেন ছবির শেষ পর্যন্ত। কিন্তু শেষটা বলে ছবিটাকে মারতে চাই না। তাছাড়া, রহস্য তো থেকেই যায়– এইটেই সবথেকে বড় প্রাপ্তি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.