‘বল্লভপুর’-এর পরে ‘তালমার রোমিও জুলিয়েট’ সিরিজেও তাঁর গান মানুষের মনে ধরেছে। অভিনেতা দেবরাজ ভট্টাচার্যর জনপ্রিয়তা ঊর্ধ্বমুখী। কথোপকথনে শম্পালী মৌলিক।
কীসের শুটিংয়ে ব্যস্ত এখন?
কৌশিক হাফিজির ‘ভূত্তেরিকা’-র শুটিং চলছে। এটা মূলত তিনজন পেত্নির গল্প। আমি একটি পেত্নির বয়ফ্রেন্ডের মতো চরিত্রে রয়েছি।
দর্শক আপনাকে প্রথমত অভিনেতা হিসাবে চেনে। তারপর আপনার গান ভালোবেসেছে। এতটা ভেবেছিলেন?
না, একেবারে ভাবিনি। বিশেষত, গান নিয়ে তো কোনওদিন ভাবিনি। ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ আমার প্রথম মিউজিক ডিরেকশন। তার আগে আমি থিয়েটারে মিউজিক করেছি। গাইতে পারি, সেখান থেকে কেউ বলেছিল মিউজিক করবি না কি, আমি ভাবলাম করি। তার পরে একটু আত্মবিশ্বাস আসে থিয়েটারে। প্রথম থেকে আমার গাইড-মেন্টর বলতে পারেন বাবানদা (শুভদীপ গুহ), অনির্বাণও (ভট্টাচার্য) ছিল। সবটা মিলে হয়েছে।
‘বল্লভপুর’-এ আপনার অভিনয় এবং গান দুটোই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এবার ‘তালমার রোমিও জুলিয়েট’-এর ক্ষেত্রে ‘দুহাতে মুঠো ভরে’ আর ‘চুপিসারে ভালোবাসা জারি আছে’, দুটো গানই দারুণ ভালোবেসেছে শ্রোতারা। আলাদা কোনও প্রস্তুতি ছিল?
না, প্রথমত স্ক্রিপ্টটা আমি অনেকদিন আগে থেকে জানতাম। অর্পণ (গড়াই), দুর্বার (শর্মা) আমার অনেক বছরের বন্ধু। অর্পণ ছোট ভাইয়ের মতো বলা যায়। ওরা যখন স্ক্রিপ্টটা লেখা শুরু করে, তখন থেকে আমি জানি, কীভাবে ভাবছে ওরা। তার পরে যখন অনির্বাণ (ভট্টাচার্য) প্রোজেক্টে ঢোকে তখন ফাইনালি গান কী হবে ঠিক হয়। এখনও পর্যন্ত ছবি বা সিরিজে যা গান করেছি, সবসময় লিখেছে অনির্বাণ। এই ‘জেল’ করাটা আমাদের মধ্যে হয়ে গেছে। ও যখন লেখাটা পাঠায়, কিছু ব্রিফ করে না। বাকিটা ওর মাথায় থাকে। আমি যখন সুর করি ঠিক ক্লিক করে যায়। এরপর হয়তো একটু এক্সপেরিমেন্ট বা সামান্য এদিক-ওদিক হয়। ‘লাল রং’ যখন সুর করেছিলাম, প্রথমে ভেবেছিলাম বিচ্ছেদের গান। পরে দেখা গেল, এখানে বিচ্ছেদ মুখ্য নয় ফলত, গানটাকে প্রেমের আঙ্গিকে করতে হবে। তখন আমি সুর পাল্টেছিলাম একটু। ‘ভালোবাসা জারি আছে’ আবার উচ্ছ্বাসের গান। ফার্স্ট ড্রাফট লেখার সময়ই এই গানটার সুর করা। প্রোমোশন হিসাবেই যাবে ঠিক ছিল। পরবর্তীতে সবাই বলে এই গানটার প্রচুর চাহিদা। তারপরে সিরিজে গানটা রাখা হয়, এবং সুরাঙ্গনা মাঝের অংশটা গায়।
এখন অভিনেতা হিসাবে, না গায়ক হিসাবে বেশি প্রতিক্রিয়া পান?
এটা মনে হয় ফিফটি-ফিফটি, ঠিক বলতে পারব না (হাসি)।
আপনি নিজে কোনদিকে ঝুঁকে?
আমি সবসময় অ্যাক্টিংয়ের দিকে ঝুঁকে। কারণ, ওটাই শিখেছি। গান শিখিনি কোনওদিন। আমার বাড়িতে সবাই গানবাজনা করত, সেই জায়গা থেকে আমার কানটা তৈরি ছিল। আমার গুরু হচ্ছে আমার কান। সেই জায়গা থেকে আমার সেন্স আছে এবং সেন্স অ্যাপ্লাই করার ক্ষমতা। অভিনয় ছোটবেলা থেকে শিখেছি, এটাই করতে চেয়েছি।
আপনার আদি বাড়ি তো বনগাঁয়?
হ্যাঁ। আমার জন্ম যদিও শিলংয়ে, বাবার চাকরিসূত্রে। তার পরে আট বছর বয়স থেকে বনগাঁয়।
আপনার খ্যাতিতে বনগাঁর মানুষের কেমন প্রতিক্রিয়া?
বনগাঁ অদ্ভুত জায়গা। সীমান্তবর্তী অঞ্চল, সংস্কৃতিটা অন্যরকম। একটা বয়সের পরে, হয় মানুষ পড়াশোনা করে কলকাতা চলে যায়, নয় বর্ডারে চলে যায়। দুটোই এক্সট্রিমের মাঝে কেউ কেউ অল্পবিস্তর নাম করছে। ১৬-১৭ বছর পর্যন্ত ছেলে-মেয়ের যখন কিছু হচ্ছে না, বিশেষ করে ছেলেদের ক্ষেত্রে, সে তখন বর্ডারে গিয়ে কাজ করবে। এটা বনগাঁর পুরনো সংস্কৃতি। তারপরে আসে শিল্প-সংস্কৃতি। দুটো এক্সট্রিমের মাঝে অল্পবিস্তর নাম করছে। আমি বলব না লোকে আমাকে একেবারে চেনে না। ২০০৭ সাল থেকে আমি কলকাতায়, বনগাঁয় যাওয়া কম হয়, অ্যাফিলিয়েশন কম। অনেকেই চেনে আমাকে, তবে হুট করে দেখে হয়তো চিনতে পারবে না। সেটা অবশ্য এখানেও হয় আমার। আমি এখনও ট্রেনে-বাসে ঘুরি। আমাকে দাড়ি কাটা অবস্থায়, আর রাখা অবস্থায় একদম অন্যরকম লাগে। বাসে কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করলে অনায়াসে বলতে পারি– ‘না, না। কে বলুন তো দেবরাজ? অনেকেই বলছে।’ (হাসি)
এই সাফল্যে মা-বাবার কী প্রতিক্রিয়া?
মা-বাবা খুব খুশি। প্রথমে মনে করত, এ বখে গেল। কারণ, পড়াশোনায় ভালোই ছিলাম বলে ওদের বিশ্বাস। নিশ্চিন্তে চাকরি করে সেট্ল করা যেত। তা বাদ দিয়ে ফ্যা ফ্যা করে থিয়েটার করে বেড়ালাম। কোনওদিন আমি চাকরির পরীক্ষা দিইনি মাস্টার্স করেও। একবার এসএসসি দিয়েছিলাম পড়াশোনা না করে। তারপর যেটা করতে চেয়েছিলাম, তার ফল দেখা যাচ্ছে এখন অন্তত একটু একটু করে। সেই জায়গা থেকে ওঁরা খুশি।
‘বল্লভপুরের রূপকথা’ তো জীবন বদলে দিয়েছে। তারপরে ‘অ্যাডভোকেট অচিন্ত্য আইচ’ আরও নানা কাজে চোখে পড়েছেন। যতটা কাজ পাবেন আশা করেছিলেন, সেটা কি হয়েছে মনে হয়?
কাজ নিয়ে বিরাট প্রত্যাশা নেই। র্যাদার কম কাজ বেশি অবসর চাই। সেটা তো খুব মুশকিল বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে। মনে হতে থাকে, দুমাস পরে চলবে কী করে। চাই ভালো কাজ। বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় একটা খুব ভালো কথা বলেছিলেন, ‘দুর্গরহস্য’ করতে গিয়ে, ‘ভালো কাজ সারাজীবনে একটা-দুটো পাবে। এই একটা-দুটো কাজ দিয়েই লোকে তোমাকে সারাজীবন মনে রাখবে। সে তুমি দেড়শো ছবি করে নিলেও ওটাই হবে।’ আমি দেখলাম এটাই ফ্যাক্ট। আমি আমার চরিত্রের প্রতি সৎ থাকার চেষ্টা করি। তারপর হয়তো অ্যাজ আ হোল তেমন কোনও ইমপ্যাক্ট থাকল না। বা আমার মনে হল, অ্যাক্টর হিসাবে তেমন কিছু অর্জন করতে পারলাম না। তার মধ্যে ভালো কাজের খোঁজ থাকে। ‘বল্লভপুর’ আমার এখনও পর্যন্ত যা করেছি, তার মধ্যে সেরা কাজ, নিজের মতে। সেইটা অন্য কোনও কাজ দিয়ে ছুঁতে পারিনি। সেটা আমার একার ব্যর্থতা নয়, সকলেরই। ‘অচিন্ত্য আইচ’-এর ক্ষেত্রে অবশ্য লোকজন ভালোলাগা জানিয়েছে। ভালো চরিত্রের খোঁজ জারি থাকবে।
‘বল্লভপুরে’র পর সিনেমার অপেক্ষা আছে?
আর ছবির জন্য কেউ সেভাবে বলেনি। অপেক্ষা নিশ্চয়ই আছে। বড়পর্দায় নিজেকে দেখতেও ভালো লাগে। ছোটবেলা থেকে আমি নিজেকে সেখানেই দেখতে চেয়েছি। সেটা যখন আর হচ্ছে না, একটা আক্ষেপ থাকেই। বড়পর্দায় এমন কয়েকজন আছেন যাঁদের দেখে তাঁদের মতো হতে চেয়েছি। যেমন, আমি রবি ঘোষের প্রচণ্ড ফ্যান। বা কালী ব্যানার্জির ভক্ত। ড্যানিয়েল ডেলুইসকে ঈশ্বর মনে করি। বা অ্যাল পাচিনো, বা ইরফান খান। মনে হয় এঁদের যদি কপিও করতে পারতাম। তখন আক্ষেপ হয়, অনেকদিন ভালো কাজ করা হয়নি।
২০১৮ পর্যন্ত মিনার্ভা রেপার্টরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যতদূর জানি।
হ্যাঁ, ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত। তার পরে প্রথম ‘বিবাহ অভিযান’-এ অভিনয় করি, ওটার টাইটেল ট্রাকও আমার গাওয়া। খুব খারাপ অভিনয় করেছিলাম। একেবারে ক্যামেরা এক্সপিরিয়েন্স ছিল না। থিয়েটার থেকে পর্দায় এসে মানাতে একটু সময় লেগেছিল প্রথমে। ২০১৮-’১৯-এ মেগাতে অভিনয় করি। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে এরকমভাবে কাজ হয়! প্রথমদিন কাজ করে প্রায় পালিয়ে এসেছিলাম। তারপর থেকে ভয় কাটিয়ে আবার এলাম, দেখলাম সিনেমা-সিরিজে ওভাবে কাজ হয় না। এখন আর সিরিয়াল করতে অসুবিধা হবে না। তবে করিনি।
শেষ প্রশ্ন, ‘ভালোবাসা জারি আছে’ এমন দরদ দিয়ে গেয়েছেন। আপনার জীবনে ভালোবাসা নেই?
ভালোবাসা তো সবার জন্য আছে। তবে আলাদা কোনও মানুষ নেই এখনও (হাসি)।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.