কিশোর ঘোষ: নয়ের দশকে যাঁরা হাইস্কুল কিংবা আরও বড়, তাঁরা হাজারি ঠাকুরকে ভুলতে পারেননি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত, রাজা সেন পরিচালিত আদর্শ হিন্দু হোটেলের কেন্দ্রীয় চরিত্র হাজারি ঠাকুর। সাত ও আটের দশক থেকে থিয়েটার উপভোগ করেছেন যাঁরা, ‘চাক ভাঙা মধু’র মতো নাটক চেখেছেন, তাঁদের মনে গেঁথে রয়েছে শোষক ও শোষিতের জীবনসংলাপ। যাঁরা তথাকথিত ‘বুদ্ধিজীবী’ নন, তাঁরা অঞ্জন চৌধুরী পরিচালিত ‘শত্রু’ সিনেমার ‘ভিলেন’ নিশিকান্ত সাহাকে মনে রেখেছেন।
এমন দাপটের পর মনোজ মিত্রকে অভিনয় শিল্পের শচীন তেণ্ডুলকর বললে কেউ রাগ করবেন না। যেহেতু নিজের এরিনায় ‘টেস্ট’, ‘ওয়ানডে’, ‘টি-টোয়োন্টি’… সবেতেই দক্ষতার চূডান্ত প্রমাণ দিয়েছেন খুলনার ছেলে, পিঠে কাঁটাতার, ইস্টবেঙ্গল! বড় শিল্পী হব, অথচ দুঃখ চাখব না, হয় নাকি? পিজ্জার দোকান বন্ধ থাকার মতো দুঃখ না, প্রশান্ত মহাসাগরের মহীখাত লজ্জা পায় এমন গভীর দুঃখ। একটি দেশে জন্মালাম, সে দেশের পরাধীনতা ও স্বাধীনতা নিয়ে আবেগে ভাসলাম। সেই দেশ-ভিটে-বাড়ি-নদী-গাছ-পাখি… আচমকা বিদেশ হয়ে গেল!
কদিন আগেই ‘দেশভাগ সিন্ড্রোমে’ ভোগা ঋত্বিক ঘটকের রাজশাহীর বাড়ি ধ্বংস করেছে দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশের নাগরিকেরা। মনোজ মিত্রের জন্ম ১৯৩৮ সালে, অবিভক্ত বাংলার খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার ধূলিহর গ্রামে। ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট, মনোজের বয়স তখন ৯ বছর। বড়দের থেকে জানেন পৈতৃক নিবাস খুলনা জেলা পড়বে ভারতে। একদিন পরে জানতে পারেন, খুলনা পড়েছে পাকিস্তানে। নিয়তির এই নিষ্ঠুর পরিহাসে বিরাট আঘাত পায় মিত্র পরিবার। আজীবন বুকের গহনে সেই বেদনায় পুড়েছেন সংবেদনশীল শিল্পী মনোজ। এই সূত্রে ঋত্বকের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় তিনি।
সেই ভিটে-মাটি-গাছ-বাগানের ছায়া ও মায়া মেলে ‘সাজানো বাগান’? স্কুলজীবন থেকেই থিয়েটারচর্চা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে দিয়েছিল মনোজকে। কলেজে জীবনে পার্থপ্রতিম চৌধুরীর মতো বন্ধুদের সঙ্গলাভ এবং ‘সুন্দরম’ প্রতিষ্ঠা লক্ষ্য পৌঁছতে সাহায্য করে। কাজ দিয়েই বাংলা থিয়েটার জগতে নিজস্ব-বন্দর গড়েন রাজশাহীর ছেলে, একের পর এক নাটক রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয়ে। সূত্রপাত হয় ২১ বছর বয়সে লেখা প্রথম নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’ থেকে। শুধু লেখা নয়, নির্দেশনা এবং অভিনয়েও মনোজ নিজের জগত তৈরি করেন।
১৯৮০ সালে ‘সাজানো বাগান’ নিয়ে তপন সিংহ ছবি তৈরি করলে চলচ্চিত্র অভিনেতা মনোজ মিত্রের জন্ম হয়। ১৯৮৪-তে অঞ্জন চৌধুরীর ছবি শত্রুতে ‘ভিলেন’ নিশিকান্ত সাহার চরিত্রে জাত চেনান মনোজ। নিশিকান্তকে দেখে পূর্বসূরি উৎপল দত্তের কথা মনে পড়ে বাঙালির। উল্লেখ্য, একাধিক ছবিতে খলচরিত্রে অভিনয় করেও মনোজ কখনও টাইপকাস্ট হননি। ঠিক উৎপল দত্তের মতো! ফলে ১৯৮৯-তে যখন দূরদর্শনের জন্য ধারাবাহিক তৈরি করেন পরিচালক রাজা সেন, আদর্শ হিন্দু হোটেলের সেই মানবিক হাজারি ঠাকুর চরিত্রে মানিয়ে যায় কিংবদন্তি অভিনেতাকে। আসলে সবটাই যে অভিনয় দক্ষতার উপরে নির্ভরশীল, তা নাটক থেকে সিনেমা, সিনেমা থেকে ধারাবাহিকে বারবার প্রমাণ করেন মনোজ। সেই কারণেই তপন সিংহ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকের পাশাপাশি অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, হরনাথ চক্রবর্তী, প্রভাত রায়, অঞ্জন চৌধুরীর মতো মূলধারার পরিচালকদের ছবিতেও চুটিয়ে কাজ করেন তিনি।
নাটক-সিনেমা-ধারাবাহিক এই ত্রিস্তর ডিঙিয়ে সমান্তরালভাবে চলেছে কিংবদন্তির লেখালিখি। মূলত অজশ্র নাটক লিখেছেন তিনি। ‘চাক ভাঙা মধু’র মতোই ‘সাজানো বাগানে’ ভেঙেছেন নাট্য রচনার পুরনো ধারাকে। পরবর্তীকালের রচনা ‘দম্পতি’, ‘আমি মদন বলছি’-র মধ্যেও রয়েছে সিরিও কমেডির মনোজ মিত্র টাইপ ঘরানা। নাটকের এই ধারা বাহিত হয়েছে ‘কেনারাম বেচারাম’, ‘নরক গুলজার’, ‘সাজানো বাগান’, ‘দেবী সর্পমস্তা’, ‘অলকানন্দার পুত্রকন্যা’, ‘ছায়ার প্রসাদ’, ‘নাকছাবিটা’য়…। নাট্যকার মনোজের লেখার ধারে তাঁর নাটক পাঠেও তৃপ্ত হন পাঠক। অতএব, মহান এই বাঙালিকে ‘মনোজ শচীন মিত্র’ বলে ডাকাই যায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.