বিশাখা পাল: এই গল্প ‘তিন ইয়ারি কথা’ নয়। তিন ইয়ারের গল্প। বন্ধুত্বের থেকেও বন্ধুদের জীবন এখানে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। বিক্রম, চন্দন আর অতনু- একজন কর্পোরেট জগতের মানুষ, একজন সোনার ব্যবসায়ী আর তৃতীয়জন সফল লেখক। এই তিন বাল্যবন্ধুর বর্তমানটা ঝকঝকে হলেও একটি ছাইচাপা অতীত আছে প্রত্যেকের। ‘সামসারা’র গল্প বর্তমান ও অতীতের সেই মেলবন্ধন।
সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে যে অনেক কিছু পিছনে ফেলে আসতে হয়, ‘সামসারা’ সেই কঠোর বাস্তবকে সেলুলয়েডে তুলে ধরেছে। এ এক জার্নির গল্প। বিক্রমের স্ত্রী নিরুদ্দেশ। পুলিশ অফিসার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীয়ের খোঁজ চালাচ্ছে। চন্দনের যৌনজীবন সুখের নয়। বাড়ির বাইরে মেয়ে দেখলেই সে বিছানায় টেনে নিয়ে যেতে চায় বটে, কিন্তু ঘরের বউয়ের সঙ্গে মিলিত হতে গেলেই তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে পিসতুতো দিদির অবয়ব। আর অতনু এমন এক লেখক যার নাম বেস্টসেলারের তালিকায় আছে। কিন্তু তাকে তাড়া করে বেড়ায় এক ‘ভূত’। কে সে? সেই পর্দা উন্মোচিত হয় সামসারায় গিয়ে।
অতনু তার পরবর্তী উপন্যাস ‘পরপারে’ লিখতে পারছে না। এই নামকরণের মধ্যে দিয়েই পরিচালকদ্বয় আগামীর ইঙ্গিত দেন। যাই হোক, উপন্যাসের প্লট খুঁজতে অতনু বেরিয়ে পড়ে সামসারার পথে। বন্ধুকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে আরও দু’জন। তবে উদ্দেশ্যহীনভাবে তারা বেরিয়ে পড়েনি। অতনু তার লেটার বক্স থেকে পেয়েছে একটি মানচিত্র। সেই সূত্র ধরেই যাত্রা শুরু। কিন্তু কে তাকে সেই মানচিত্র পাঠাল, তার কোনও ইঙ্গিত কোথাও চোখে পড়েনি। যদি ধরেও নেওয়া যায় অতনুর সেই ‘ভূত’ কোনও এক অজানা জায়গার ম্যাপ পাঠিয়েছে, তাও সম্ভব নয়। কারণ সে তো অতনুর হ্যালুসিনেশন। তবে ‘ভূত’-এর একটা তার রহস্য আছে। ছবির শেষার্ধে যখন তা উদঘাটিত হবে, তখনই চিত্রনাট্যের গলদ ধরা পড়ে।
সামসারায় এসে তিন বন্ধু তাদের কালচে অতীতের মুখোমুখি হয়। নিখোঁজ স্ত্রীয়ের খোঁজ পায় বিক্রম। চন্দন দেখা পায় তার দিদির। আর অতনু? সে মুখোমুখি হয় সেই ‘ভূতে’র। কিন্তু এখানে ওই তিন চরিত্রের নাম আলাদা, পরিচয় ভিন্ন। তা সত্ত্বেও তিন বন্ধু শান্তি পায় না। তিনজনেই তিন জনের কাছে তাদের অতীতের কথা স্বীকার করে। জানায় জীবনের চড়াই-উৎরাইতে তারা ফেলে এসেছে তাদের ভালবাসা। সফল হওয়ার দৌড়ে জিততে গিয়ে গলা টিপে মেরে ফেলেছে তাদের মনুষ্যত্ব। তাই আজ সেই ফেলে আসা অতীত তাদের সামনে আয়না হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে গল্পের শেষ এখানে নয়। টুইস্ট আছে আরও। এক তো এই তিন বন্ধুর তিন কালো অতীত। আর দুই, তাদের সামসারা আসার ‘টাইম ট্রাভেল’।
ছবির কনসেপ্ট ভাল। কিন্তু চিত্রনাট্যের দুর্বলতা ছবিটি ভাল হওয়ার পথে অন্তরায়। ছবি শেষ হওয়ার পর প্রশ্ন উঠবে, অতনুর ক্যালেন্ডারের লাল কালি দিয়ে মার্ক করা ‘১০ তারিখ’ নিয়ে। আর সেই মানচিত্র? সেটাই বা কে পাঠাল? এছাড়া ছবির প্রথমার্ধ খুব বেশি রকমের শ্লথ। দ্বিতীয়ার্ধে ছবি প্রাণ পেয়েছে। কিন্তু বাঁধুনি যেন পোক্ত হয়নি। তবে ছবিতে মেঠো সুরের প্রয়োগ বেশ ভাল। অভিনয়ের দিক থেকে ঋত্বিক অসাধারণ। রাহুলও যথাযথ। তবে এদের সঙ্গে টক্কর দিতে ইন্দ্রজিতের নিজের অভিনয়ের দিকে আরও একটু জোর দেওয়া দরকার ছিল। এছাড়া সুদীপ্তা, অম্বরীশ, সমদর্শী আর দেবযানীও তাদের চরিত্র অনুযায়ী অভিনয় করেছেন ভালই। তবে অম্বরীশ ক্ষুদ্র চরিত্রেই যেন বেশি ছাপ রেখে গিয়েছেন। পরিচালকদ্বয় সুদেষ্ণা রায় ও অভিজিৎ গুহ চেষ্টার ত্রুটি করেননি। সাসপেন্স নেহাত মন্দ নয়। ছবির কয়েকটি ফ্রেম তো রীতিমতো ভাবাবে। তা সত্ত্বেও স্রেফ চিত্রনাট্যের কারণেই ‘সামসারা’ মোটামুটির পর্যায়ে রয়ে যায়। চিত্রনাট্যের কয়েকটি সূক্ষ্ম গলদে অসাধারণ হতে গিয়েও আটকে যায় এই ছবি। তবে তিন বন্ধুর ভয়ানক অতীত একবারের জন্যও আপনাকে আয়নার সামনে দাঁড় করাবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.