চারুবাক: এখনকার বাংলা সিনেমায় সুপারহিট পরিচালকজুটি শিবপ্রসাদ-নন্দিতা। এটা প্রমাণিত সত্য, বাজারি হিসেব বাদ দিলেও আম দর্শকের নাড়ির স্পন্দন বুঝতে এঁরা দু’জন এখনও পর্যন্ত সিদ্ধহস্ত। সিনেমার জটিল ব্যকরণ নিয়ে কোনও ঝুঁকি নয়। সরল সাদাসিধে ন্যারেটিভই ছবির নির্মাণশরীর। নাটক, অতিনাটক, কাকতালীয় ঘটনা, যুক্তিবুদ্ধির চেয়ে আবেগঘন মুহূর্ত তৈরি করে দর্শককে প্রায় ভুলিয়ে রাখতে নিপুণ তাঁদের কলম ও ক্যামেরার কাজ।
নতুন ছবি ‘গোত্র’ মানবতা মনুষ্যত্বের ধ্বজা উড়িয়ে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির কথা বা বাণী বিতরণ করেছেন প্রায় পুরো গল্প জুড়েই। বাস্তবের ‘জয় শ্রীরাম বাহিনী’ ও গো-রক্ষকদের তাণ্ডবকে পাত্তাই দেননি। দেওয়া উচিতও নয়। ছবির প্রচার পরিকল্পনার সুযোগে গল্পটি নিশ্চয়ই দর্শকের জানা। একাকী, বয়স্কা মুক্তিদেবীর (অনসূয়া) দেখাশোনার জন্য প্রবাসী সন্তান অনি (সাহেব) বাড়িতে নিয়ে আসে তারেক আলি নামের জেলখাটা এক আসামীকে। কারণ, তারেক সত্যিই সাধারণত সুস্থজীবনে ফিরতে চায়। গোবিন্দর মন্দির-সহ গোবিন্দধামে তারেকের ঠাঁই হয় ‘তারক গুহ’ নামে। ঘটনার পরস্পরে এবং পারিপার্শ্বিকতার নানা ঘটনার সত্যিই তারেক আলি মুক্তিদেবীর হৃদয় জয় করে তাঁর সন্তান হয়ে ওঠে। তাঁর গোত্র হয় ‘মনুষ্যত্ব’।
গল্পের শাখা প্রশাখা বাড়াতে ঝুমা (মানালি) নামের এক চঞ্চলা তরুণী আগে মুক্তিদেবীর আশ্রিতা হয় এবং তাঁর সঙ্গেই তারেকের দুষ্টু-মিষ্টি আশনাই মুহূর্তগুলো অতি সোচ্চার না হলেও ব্যবসায়ীক ছোঁয়া বর্জিত নয়। যেমন ‘রঙ্গবতী, রঙ্গবতী কনকলতা’ গানটির সঙ্গে ঝলমলে নাচও সংখ্যাগুরু দর্শকের মনোরঞ্জনে অপ্রয়োজনীয়ই বলা যায়। অথচ ‘আমি তোমায় ভালবাসায় মুড়ে রাখি মা’ বা ‘এই আলো ঢোকা চোখে’ গান দু’টোর ব্যবহার নাটুকে পরিস্থিতির উপযোগী হয়েও শুনতে ভাল লাগে সুর আর গাওয়ার সৌন্দর্যের কারণে। একটাই আক্ষেপ- ছবির প্রচার পত্রে প্রায় কোথাও সুরকার অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের নাম দেখা যাচ্ছে না। গল্পে প্রশাখা হয়ে ঢুকে পড়েছে বাপি নামের প্রোমোটার (খরাজ)। অ্যাকশন দৃশ্য তেমন না থাকলেও বুকনি অ্যাকশন কম নেই।
একটাই আশ্বস্ত হওয়ার মতো অবস্থা শিবু-নন্দিতা জুটি তাঁদের লক্ষে স্থির। ধর্ম, জাতপাত গোত্রের বাইরে মানুষের প্রথম পরিচয় যে মনুষ্যত্ব এই সত্যটিকে মান্যতা দিয়েই চিত্রনাট্যের সমাপ্তি। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় পুরীর সমুদ্র তীরে মন্দির-মসজিদ-গির্জার বালির ক্যালিগ্রাফিকে পিছনে রেখে ঝুমা-তারেক দিগন্তের পথে। কাঙ্খিত সমাপ্তি। জানি এই ধরনের সামাজিক বক্তব্যে ভারী হওয়া ছবি আমোদ খোঁজা দর্শক কীভাবে নেবেন বা আদৌ নেবেন কিনা। কিন্তু পরিচালক জুটির প্রয়াসকে খাটো করা যায় না।
অভিনয়ে প্রধান চরিত্রে অনসূয়া মজুমদার তাঁর জীবনের প্রথম এত বড় চরিত্র সুযোগ পেয়ে সদ্ব্যবহার করেছেন। তাঁর রাগ, বিরক্তি, নীরব সহানুভূতির প্রকাশগুলোও সুন্দর। নাইজেল আকারার অভিনয়ও বেশ সাবলীল। মানালি দে একটু বেশি ছটফটে। আর বাড়ির পুরুত ঠাকুরের ভূমিকায় অম্বরীশ ভট্টাচার্য কমেডিকে ভাঁড়ামির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়। শিবু-নন্দিতার চোখ এড়াল কীভাবে অম্বরীশের বাফুনিপনা? হয়তো সংখ্যাগুরু দর্শককে খাওয়ানোর জন্যই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.