চারুবাক: ফ্লপ নায়ক উত্তম থেকে মহানায়ক উত্তম কুমারে উত্তীর্ণ হওয়ার সব ওঠাপড়ার কাহিনি বাংলা সিনেমার দর্শকদের জানা। তাঁকে নিয়ে লেখা দু তিনটে বই, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী, সুপ্রিয়া দেবীর একাধিক রচনা, সুচিত্রা সেন নিজে কিছু না লিখলেও, তাঁর জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে কম রচনা নেই। সুতরাং, শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিত্রনাট্যে এবং অতনু বসুর পরিচালনায় ‘অচেনা উত্তম’ (Achena Uttam) ছবিতে আমরা চেনা উত্তমকেই বেশি পেলাম। অচেনা উত্তম বলতে পাওয়া গেল কলকাতায় সাম্প্রতিক দাঙ্গার সময় (১৯৪৬ সাল) তাঁর নিজের লেখা হিন্দি গান ‘হিন্দুস্থান মে ক্যায়া হ্যায় তুমহারা বৃটিশ বেচারা’ গানটির ব্যবহার এবং ভাই তরুণ কুমার যে উৎপল দত্তর কাছে নাটকের নাড়া বেঁধেছিলেন এমন কিছু অচেনা তথ্য।
জীবনের যেকোনও ক্ষেত্রে একজন অতি সফল মানুষের, ব্যক্তিগত জীবন হয় একাকীত্বের। নিসঙ্গতা তাঁর সঙ্গী। সংসারের মানুষজন তাঁকে ভুল বোঝে এবং সেখান থেকেই তৈরি হয় সাফল্যের পিছনে এক যন্ত্রণার ছায়া। উত্তমকুমারের জীবনেও তুঙ্গ সাফল্যের উপরি পাওনা হিসেবে শিল্পীর যন্ত্রণাও ছিল। শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় গভীর অবিনিবেশ সহকারে তাঁর অভিনয় এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনকে অনুসন্ধান করে চিত্রনাট্য সাজিয়েছেন। তাঁর সেই সাজানোটা অবশ্যই সরলৌকিক নয়। পরিচালক অতনু বসু চিত্রায়নেও সেই ননন্যারিটিভ গঠনকে অনুসরণ করায় ছবির নাটকীয়তার ওঠা-নামা দর্শককে বসিয়ে রাখে। সুচিত্রা সেন, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে নায়ক উত্তম কুমারের সম্পর্কগুলোর উপস্থাপনা, বন্ধুত্ব, প্রেম এবং পেশাদারিত্ব মিলিয়ে একজন সম্পুর্ণ মানুষের পরিচয় তুলে ধরে। স্ত্রী গৌরীদেবী সহ তাঁর পারিবারিক মণ্ডল এসেছে ছবিতে। কিছু দর্শকের কাছে অচেনা লাগতে পারে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে নায়কের ভুল বোঝাবুঝি। তবে চেনা ঘটনা, ময়দানে সরোজ দত্ত খুনের দৃশ্য দেখার পর নায়কের শহর ছেড়ে যাওয়া। কিন্তু অচেনা রয়ে গেল শিল্পী উত্তম কুমারের অন্তর যন্ত্রণা। অভিনেতা ও শিল্পী হিসেবে তাঁর সব স্বপ্ন পূরণ হয়নি। জীবনের শেষপর্বে এসে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা তাঁকে ব্যথিত করেছিল। সেই যন্ত্রণাই তাঁর মৃত্যুর পরোক্ষ কারণ এমনটাই আভাস দেওয়া হয়েছে ছবিতে। এই পর্বটি সত্যিই অচেনা। ছবির শুরুতে ‘নায়ক’ ছবির স্বপ্ন দৃশ্যের মতো উত্তমকুমারকে যেভাবে তাঁর অন্তর্দন্ধ ও মানসিক যন্ত্রণায় কাতর দেখানো হল, সেই সুর পুরো ছবিতে বজায় নেই। সাফল্যের পিছনে অসাফল্য মানসিক যন্ত্রণা, ব্যক্তিগত সমস্যায় জড়িত উত্তম কুমারকে দেখলে সত্যিই অচেনা লাগে। শিবাশিস, অতনু জুটির কাজ শিল্প উত্তীর্ণ না হলেও, উত্তম প্রিয় দর্শক মনে দাগ কাটবে। বিশেষ করে দুটি দৃশ্য- সত্যজিত রায়ের ‘ঘরে বাইরে’ ছবিতে সন্দীপের চরিত্রে অভিনয়ের অফার প্রত্যাখান করার পর্ব এবং একান্তে একবার বন্ধু সুচিত্রার কাছে উত্তমের পৌঁছে যাওয়া এবং তাঁকে ফিল্মে ফিরিয়ে আনার ব্যর্থ চেষ্টার পর্ব।
এই ছবি দেখতে বসে দর্শক শুধু উত্তমকুমারকে (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়) দেখতে উৎসুক নন। উৎসাহ থাকে সুচিত্রা (ঋতুপর্ণা), সাবিত্রি (দিতিপ্রিয়া), সুপ্রিয়া (সায়ন্তনী রায়চৌধুরী), গৌরী দেবী (শ্রাবন্তী), সত্যজিৎ রায় (প্রিয়াংশু চট্টোপাধ্যায়), সুমিত্রা (সম্পূর্ণা লাহিড়ী), তরুণ কুমার (বিশ্বনাথ বসু) দিকেও। এরা কেউই, অরিজিনালের মতো অভিনয় করার চেষ্টা করেননি, ভালই করেছেন, যে যাঁর নিজেদের মতো অভিনয় করে। তবে উত্তম কুমারের চরিত্রে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় সত্যি অসাধারণ। নিজের ম্যানারিজমকে সরিয়ে উত্তমকুমারকে জীবন্ত করে তোলায় আন্তরিক চেষ্টা করেছেন এবং অনেকটাই সফল। তাঁকে ধন্যবাদ। তবে চিত্রনাট্য সম্পর্কে দুটি কথা উত্তমকুমার প্রযোজক দেবেশ ঘোষের পার্টিতে অসুস্থ হয়ে মাঝরাতে হাসপাতালে ভরতি হন। মৃত্য হয় পরদিন দুপুরে। কিন্তু ছবিতে এমনভাবে দেখান হল যে উত্তমকুমার অসুস্থ হয়ে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ছিলেন। এটা তথ্যগত ভুল এবং সাবিত্রীর হাসপাতালে গিয়ে কথা বলার ঘটনাটিও চিত্রনাট্যকরের কল্পনাপ্রসূত। এগুলো এড়াতে পারলে ভাল হত।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.