নির্মল ধর: মাঝে মধ্যে কিছু ছবি সাধারণ চেহারা নিয়ে থাকে, অথচ গল্পের বাইরেও অন্য একটা গল্প খুঁজে নিতে হয় দর্শককে। আর সেটাই সেই ছবির অসাধারণত্ব। যে গল্প কখনই সরল নয়, হয়তো বা বাস্তবও নয়। কিছুটা কল্পনা, কিছুটা মনের ভেতরকার অপূর্ণ বাসনার প্রতিফলন। তাকে কি পরা বাস্তব বলা যায়, নাকি ভূতুড়ে কাণ্ড! সাধারণ চোখে অবশ্যই ‘ভূতুড়ে’, কিন্তু কোথাও যেন গোপন বাসনার সঙ্গে কল্পনা মিশে গিয়ে এক পরা বাস্তব তৈরি করে। মানস বসুর এই নতুন ছবি ‘ছবিয়াল’ (Chobiyal) সেই গোত্রের।
ছবিটা দেখতে বসে মনে হচ্ছিল – বাংলা সিনেমায় এখনও কিছু অপ্রকৃতিস্থ মানুষ আছেন বা রয়েছেন, যাঁরা ক্যামেরা নিয়ে একটু অন্যরকম ভাবনায় ছবি তৈরি করতে চান। ব্যবসা নয়, নিজের মনের মত কিছু বলতে এবং দেখাতে চান। মানস বসু (Manas Basu) তেমনি একজন ‘উন্মাদ’। নইলে এমন ভূতুড়ে মার্কা গপ্পো নিয়ে ছবি ফাঁদেন! সাহসের বলিহারি বলতেই হচ্ছে। হাবুল নামের এক ফটোগ্রাফার, যে শুধু শ্মশানে মরা মুখের ছবি তুলে জীবন কাটালো, মাঝে মধ্যে বিয়ের ছবিও তুলেছে, কিন্তু তার জীবনে প্রেম কিংবা বিয়ে কোনটাই আসেনি। এই হাবুল আচমকাই এক মৃতার মুখে অতীতের কোনও এক চেনা মুখ আবিষ্কার করে। শুধু আবিষ্কার নয়, মনে মনে নিজের স্ত্রী বলেও ভাবতে শুরু করে। তাঁর সঙ্গে জ্যোৎস্নালোকে প্রেমের গানও গায়। হাবুলের এই কাণ্ডকারখানায় বন্ধুমহলে শুরু হয় ভুল বোঝাবুঝি। তারপর শুরু হয় মানসিক চিকিৎসা এবং পরবর্তী সময়ে নিজের কল্পনাকে সত্যি প্রমাণ করতে এক রাতে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মানস-প্রেমিকার সঙ্গে হাবুলের বাড়ি ত্যাগ। না, এখানেই কাহিনি শেষ হয় না। পরিচালক দেখান গ্রামছাড়া পলাতক দু’জনের মধ্যে একজনের পায়ের ছাপ রাস্তায় পড়েনি। হাবুল কি তাহলে সত্যিই উন্মাদ হল? নাকি সে চলে গেল তাঁর কল্পনার প্রেমিকার খোঁজে, যাঁর কোনো অস্তিত্বই হয়তো নেই। হয়তো বা আছে!
পরিচালক মানস বসু এমন একটি অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে ছবি বানানোর জন্য প্রশংসার দাবি করতেই পারেন। উপরন্তু, তিনি ছবিটি বানিয়েছেন কোনওরকম ব্যবসায়িক চিন্তার ছাপ না রেখেই। শ্মশান, সেখানকার পরিবেশ, হাবুলের নিজের ছোট্ট ঘর, তাঁর তিন সাগরেদ ও সহকারী বিলেকে নিয়ে বেশ বিশ্বাস্য একটি পরিমণ্ডল তৈরি করতে পেরেছেন। তাদের রোজকার দিনলিপিও খুবই বাস্তব, জীবন্ত। একমাত্র বেশি লেগেছে তাঁদের প্রতি সন্ধ্যায় “অনুপানসহ ধ্যানের আসর” বসানোর তৃতীয় দৃশ্যটি। গানগুলিও বিষয় ও পরিস্থিতির সঙ্গে খুব একটা সম্পৃক্ত নয়। অথচ ‘ছবিয়াল’-এর শরীরে ও অন্তরে একটি অন্যরকম ছবি হয়ে ওঠার সমস্ত রসদ মজুত। মানস যদি আরও একটু সংযত হতে পারতেন। হ্যাঁ, তিনি বাড়াবাড়ি কোথাও তেমন করেননি, আর করেননি বলেই দর্শক ছবি দেখে একটু অন্যরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন। অভিজিৎ নন্দীর চিত্রগ্রহণ পরিস্থিতি মাফিক ঠিকঠাক। তবে অন্তত দু’জায়গায় দিন রাতের শট গুলিয়ে গিয়েছে। সেটা সম্পাদকের নজরে আসা উচিত ছিল।
আর এই ছবির শিল্পীরা প্রত্যেকেই চরিত্র অনুযায়ী একেবারে মানানসই। বিশেষ করে দু’টি নাম – মুখ্য চরিত্রে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় (Saswata Chatterjee) নিজের ম্যানারিজম থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকার হাবুল হতে পেরেছেন। তাঁর অভিনয়ে বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রণটি সুন্দর ধরা পরে। সহকারী বিলের চরিত্রে সেই ‘সহজ পাঠের গপ্পো’ ছবির সামিউল আলম (Samiul Alam) বেশ সাবলীল, পাক্কা অভিনেতার মত। শ্রাবন্তী (Srabanti Chatterjee) হয়েছেন কাল্পনিক প্রেমিকা লাবণ্য। তাঁর স্বল্পকালীন মিষ্টি উপস্থিতি সুন্দর। চাওয়ালার চরিত্রে জয়জিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Joyjeet Banerjee) বেশ মানিয়েছে। ‘ছবিয়াল’ আজকের বাংলা ছবির ভিড়ে অবশ্যই একটু ব্যতিক্রমী ভাবনার পরিচয় দিল, যা এখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.