সুপর্ণা মজুমদার: ফিল্ড মার্শাল স্যাম হরমুসজি ফ্রামজি জামশেদজি মানেকশ। কেমন সে মানুষ? এমন যোদ্ধা, যিনি জাপানিদের গুলিতে শরীর ঝাঁজরা হয়ে যাওয়ার পরও হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে রসিকতা করতে পারেন। আবার মুক্তিযুদ্ধে জয়ের পর অবলীলায় বলতে পারেন, “ইয়াহিয়া আমার বাইকের দাম দেয়নি, এখন দেশের অর্ধেক দিয়ে দাম মেটাচ্ছে৷” মৃত্যুকালেও যে মানুষের মুখে শোনা যায় ‘আই অ্যাম ওকে’, তাঁর চরিত্র ক্যামেরার সামনে ফুটিয়ে তোলা কোনও যুদ্ধের থেকে কম কিছু নয়। আর এই যুদ্ধে ভিকি কৌশল আক্ষরিক অর্থেই ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’। চলনে-বলনে, আদব-কায়দায়, চোখের তীক্ষ্ণ চাহনিতে তিনিই যেন ‘স্যাম বাহাদুর’ (Sam Bahadur)।
সেনার পোশাকে ভিকি বরাবর সফল। তা সে মেঘনা গুলজারের ‘রাজি’ হোক, কিংবা আদিত্য ধরের ‘উরি দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’। এবার আবার মেঘনার পরিচালনাতেই স্যাম মানেকশ (Sam Manekshaw) ওরফে স্যাম বাহাদুর হয়েছেন ভিকি। সিনেমা শুরু হয় সদ্যোজাত স্যামের ঝলক দিয়ে। জানানো হয়, কীভাবে সাইরাস থেকে পার্সি পরিবারের ছেলের নাম স্যাম হয়ে যায়। এর পরই ‘স্যাম বাহাদুর’ নামের কারণটি দেখানো হয়। আসলে মানেকশ শব্দটি এক গোর্খা সৈন্য উচ্চারণ করতে পারছিলেন না। স্যাম যখন তাঁর কাছে নিজের নাম জানতে চান, তিনি বলে ফেলেন স্যাম বাহাদুর। সেই থেকে ভারতীয় সেনায় স্যাম মানেকশ হয়ে যান স্যাম বাহাদুর।
ফিল্ড মার্শালের ৯৪ বছরের জীবনে এমন নানা গল্প রয়েছে যা আড়াই ঘণ্টার সিনেমার মধ্যে বাঁধা সত্যি কঠিন কাজ। প্রায় অসম্ভব বলা যেতে পারে। সম্পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে কাজটি করার চেষ্টা করেছেন মেঘনা গুলজার ও তাঁর টিম। তবে স্যামের জন্মের পর কাহিনি সোজা সেনা প্রশিক্ষণ শিবিরে লাফ দেয়। যেখানে তরুণ স্যাম ব্রিটিশ বাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। এখানে স্যামের সেনায় যোগ দেওয়ার কারণটি অন্তত দেখানো উচিত ছিল। কল্কি কোয়েচলিনের ক্যামিও দৃশ্যটি না থাকলেও তো কোনও ক্ষতি হতো না।
অবশ্য এর পর থেকে ছবি অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো ছুটেছে। স্বাধীনতার আগে স্যাম মানেকশ ও ইয়াহিয়া খানের বন্ধুত্ব, বাইক দিয়ে দেওয়ার ঘটনা, টিক্কা খানের সঙ্গে স্যামের বক্সিং থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, স্যামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত থেকে ফিল্ড মার্শাল হওয়ার গল্প সবই ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন মেঘনা। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যটি শিউরে ওঠার মতো। বিশেষ করে একটি টপ অ্যাঙ্গেল শট। যেখানে ছাত্রদের ঘিরে ফেলে চারদিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি চালাতে থাকে। ডার্ক থিম রেখে শুধু গুলির আগুন দেখিয়েছেন মেঘনা।
অদ্ভূতভাবে এখন বাংলাদেশে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। আর বলিউডে প্রথমে ‘পিপ্পা’, তার পর ‘স্যাম বাহাদুর’, দুই সিনেমাতেই মুক্তিযুদ্ধ দেখানো হয়েছে। নাহ, কারণ না অকারণ, সেই আলাপ-আলোচনা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের জন্যই তোলা থাক। এখানে শুধুই সিনেমা নিয়ে চর্চা। আর এই সিনেমা শুধু যুদ্ধের সিনেমা নয়, এক যোদ্ধার জীবনের গল্প। গর্বের গল্প। মর্যাদার কাহিনি।
ছবিতে স্যাম মানেকশর স্ত্রী শিলু মানেকশর চরিত্রে অভিনয় করেছেন সানিয়া মালহোত্রা। অভিনেত্রীর এখানে বিশেষ কিছু করার ছিল না। বরং অভিনয়ের সুযোগ ছিল ফতিমা সানা শেখের কাছে। ইন্দিরা গান্ধীর মতো বলিষ্ঠ চরিত্র পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ফতিমা মন কাড়তে পারলেন না। ভিকি যেখানে চাহনিতে মাত করেছেন, ফতিমার চাহনি সেখানে তুলনামূলকভাবে নির্লিপ্ত মনে হয়েছে। নীরজ কবি জওহরলাল নেহেরু হিসেবে নিজের ভূমিকা পালন করেছেন মাত্র। তবে ভিকির পাশাপাশি এই সিনেমায় যদি কেউ চমকে দিয়ে থাকেন তিনি মহম্মদ জিসান আয়ুব। ইয়াহিয়া খানের চরিত্রে তিনি এক কথায় দুর্ধর্ষ। যেমন প্রস্থেটিক মেকআপে, তেমন বাচনভঙ্গিতে। এমন অভিনেতাকে মেঘনা আরও একটি ব্যবহার হয়তো করতে পারতেন। তবে এই সিনেমায় পরিচালক শুধুই স্যাম মানেকশর উপর জোর দিয়েছেন। ছবির মাঝে মাঝে বাস্তবের কোলাজ দেখতে ভালোই লেগেছে। তবে সবেচেয়ে ভালো যদি কিছু লেগে থাকে, তা ভিকি কৌশলের অভিনয়। হ্যাঁ, রণবীর কাপুরের ‘অ্যানিম্যাল’-এর মতো হয়তো ব্যবসা ‘স্যাম বাহাদুর’ করবে না। তবে এ ছবির জন্য ভিকি কৌশল আরেকটি জাতীয় পুরস্কার পেলে অবাক হব না।
সিনেমা – স্যাম বাহাদুর
অভিনয়ে – ভিকি কৌশল, সানিয়া মালহোত্রা, ফতিমা সানা শেখ, নীরজ কবি, গোবিন্দ নামদেব, মহম্মদ জিসান আয়ুব প্রমুখ
পরিচালনায় – মেঘনা গুলজার
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.