নির্মল ধর: ‘তখন কুয়াশা ছিল’। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ উপন্যাসটি লিখেছিলেন সাম্প্রতিক বঙ্গ রাজনীতির ঘোলাজলে স্বার্থপর নেতাদের মাছ ধরার সত্যি ঘটনা নিয়ে। তাঁর কলমে এক আধা শহর, আধা গ্রামে রাজনীতির নামে দুর্বৃত্ত-শাসিত নেতার কীর্তিই কেন্দ্রীয় জায়গা পেয়েছে। পরিচালক শৈবাল মিত্র সেই কাহিনি নিয়ে বাংলায় একই নামে ছায়াছবি করেছেন।,
শৈবালের সিনেমায় দর্শক প্রায় প্রতিটি ফ্রেমে, নেতা-মস্তানদের সংলাপে, গ্রামের অদ্ভূত পরিবেশে আজকের সময়টাকে উপলব্ধি করবেন যা আজকের বাংলা ছবিতে বিরল। আর তা এই ছবির প্রশংসার একটা বড় দিক। মেরুদণ্ড হারিয়ে ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতির কাছে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত হয়ে যাওয়াটাই এখন শিল্প-ব্যবসার মূল মন্ত্র। শিল্প? সে তো কবেই শূন্যে মিলিয়েছে!
এমন পরিপ্রেক্ষিতে ‘তখন কুয়াশা ছিল’ (Tokhon Kuasa Chilo) নিশ্চয়ই একটা দুঃসাহসী প্রয়াস। ছবির প্রথম অংশ দেখতে দেখতে মনে হয় এমন চওড়া বুকের পাটা এই শহরে তাহলে এখনও আছে! যিনি কোনও ভনিতার আশ্রয় না নিয়ে সরাসরি রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে এমন বুক চিতিয়ে কথা বলতে পারেন। গণ ফ্রন্ট এবং বাংলা বাঁচাও, এই দুই পার্টি যে কোন দলের প্রতীক সেটা বুঝে নিতে দর্শকের বিন্দুমাত্র অসুবিধে হবে না।
গণ ফ্রন্ট এখন হেরোর দলে। গলাকাটা খুনি শচীনকে সঙ্গী করে বাংলা বাঁচাও দল এখন রাজ্য দখলে রেখেছে। পুটু নামের শিক্ষিত ভদ্র তরুণের দল এখন নোংরা রাজনীতির পরিবেশ দেখে বীতশ্রদ্ধ। নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। এমনকী প্রতিবাদেও যেন নিরুৎসাহ। সেই সুযোগে তুমুল হইচই বাঁধিয়ে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে বাংলা বাঁচাও দল নিজের শাসন কায়েম করতে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর গণ ফ্রন্টের সমর্থক প্রবীণ মাস্টারমশাই এবং বেকার শিক্ষিত তরুণ পুটু কিঞ্চিৎ যেন বিভ্রান্ত। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে গলাকাটা শচীন খুন করে প্রতিপক্ষের এক কর্মীকে। পুটু সেটা মানতে পারে না। নিজের অক্ষমতায় জর্জরিত এবং বিবেকের তাড়নায় সে শচীনকেই খুন করে বসে।
গণ ফ্রণ্টের নেতা বাঁচিয়ে দেয় পুটুকে। তিন মাস পর জেল থেকে বেরিয়ে পুটু নিজেই নতুন এক ‘আতঙ্ক’ হয়ে ওঠে গ্রমের মানুষের কাছে। রাজনীতির বদল ঘটে, কিন্তু দুর্বৃত্তায়ন বদলায় না। এমন ইঙ্গিতেই ছবির সমাপ্তি। মূল কাহিনির মধ্যে আজকের জীবনের প্রতিফলন দেখা যায়। পরিচালক শৈবাল কিন্তু ছবির কাঠামোয় আরো কিছু সিনেমাটিক এলিমেন্ট রেখেছেন, যা অনেক দর্শকের কাছে কিছু প্রশ্ন তুলবে। মাষ্টারমশাই এর মেয়ে মৌয়ের সঙ্গে পুটুর নীরব প্রেমের ইঙ্গিতের সঙ্গে শচীনের সম্পর্ক রাখাটা কি জরুরি ছিল? শচীনের সন্তান গর্ভে নিয়েই মৌ পুটুকে বিয়ে করতে রাজি হয়। কিন্তু এই মৌ আবার পুটুর মৃত্যুর পর বিধবার সাজ পরে পুটুকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এ কেমনভাবে সম্ভব? গল্পের এই জটিলতার সঙ্গেই আবার ফিল্মি স্টাইলে আন্তর্জাতিকতা (হিটলারের ছবি, যুদ্ধের ছবি, বেলা চাও গানের ব্যবহার) আনতে চাওয়া বড্ড আরোপিত লাগে। তা দর্শকদের বিভান্তির কারণ হতে পারে।
বরং বেগমপুর গ্রামের ঘটনা সহজ সরল ভাবে প্রকাশ করলেই ছবিটি অনেক বেশি গ্রাহ্য হতে পারত সাধারণ দর্শকের কাছে। শৈবাল এমনটি কেন করেছেন, সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না – একটা ইন্টালেকচুয়াল মোড়ক দিয়ে তিনি ছবির বক্তব্যকে একটু আড়াল করতে চেয়েছেন। তিনি সফল তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু প্রশ্নটা থাকেই – কেন এই ইন্টালেকচুয়াল মুখোশের আড়াল? তাঁরও কি কোন ভয় বা আশঙ্কা ছিল ছবির ভবিষ্যৎ নিয়ে?
যাইহোক, এই ক্লীব-নীরব সময়ে দাঁড়িয়ে কিছু সাহস তো তবু শৈবাল দেখালেন! কুয়াশা ঘেরা পরিবেশ দিয়ে ছবি শুরু। প্রায় পুরো ছবিটাই কুয়াশাচ্ছন্ন। তবে একেবারে প্রায় শেষ দৃশ্যে এসে কুয়াশা কাটে, কিন্তু সেটাও ক্ষণিকের, পুটুর নতুন অবতার দেখে সব্বাই পালাতে শুরু করলে আবার ফিরে আসে কুয়াশা। পরিচালক ও আলোকচিত্রীর এমন ভাবনার জন্য ধন্যবাদ।
এই ছবির আর একটা বড় গুণ আবহ, যা করেছেন তেজেন্দ্র মজুমদার। কোথাও নাটকীয় বা সোচ্চার নয়, অথচ পরিস্থিতির সঙ্গে অতীব মানানসই। ছবির শেষ পর্বে “আমি যে তোর আলোর ছেলে…” গানটির ব্যবহারই পর্যাপ্ত, ‘বেলা চাও…’ গানের সুর না থাকলেও অসুবিধে হত না। অভিনয়ে পুটুর ভূমিকায় একেবারে অন্য এক শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে (Saswata Chatterjee) দর্শক পাবে। নিজের সব ম্যানারিজম সরিয়ে তিনি পুটু হয়ে ওঠায় কোনও ত্রুটি রাখেননি। প্রবীণ মাস্টারের চরিত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (Soumitra Chatterjee) ছাড়া আর কেইবা থাকতে পারতেন! মৌয়ের চরিত্রে বাসবদত্তার (Basabdatta Chatterjee) তেমন অভিনয় দেখানোর সুযোগ ছিল না। যেটুক পেয়েছেন, মন্দ করেননি।
শচীনের চরিত্রে বরুণ চক্রবর্তী অল্প সুযোগই চোখ কেড়ে নেন। এছাড়া পরিচিত মুখের মধ্যে প্রয়াত অরুণ গুহঠাকুরতা, মায়া ঘোষ, দেবরঞ্জন নাগ, নিমাই ঘোষ, সোহাগ সেন, সুকৃতি লহরী, পারমিতা মুখোপাধ্যায়দের উপস্থিতি ক্ষণিকের হলেও চোখের শান্তি তো বটেই। এমন একটি ব্যতিক্রমী ভাবনার ছবির জন্য প্রদীপ চুরিওয়ালের এগিয়ে আসার সিদ্ধান্তকেও সুস্বাগতম।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.