বিশ্বদীপ দে: ‘‘তুমি ব্যাটম্যান না সুপারম্যান যে তোমার কিচ্ছু হবে না?’’, ‘‘তার থেকেও সাংঘাতিক। অর্ডিনারি উওম্যান। ভেরি ভেরি ডেঞ্জারাস।’’ এই সংলাপটিকে ‘বোধন’ (Bodhon) নামের ওয়েব সিরিজটির থিম ধরা যেতে পারে। দুর্গাপুজোর (Durga Puja 2022) সময় মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিরিজ যে শেষপর্যন্ত নারীশক্তির বিজয়ী হয়ে ওঠার কাহিনি বলবে তা ট্রেলার থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
এক কলেজছাত্রীর গণধর্ষণকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় অদিতি রায় পরিচালিত সিরিজের গল্প। সাধারণ মেয়ে শিঞ্জিনী। বিবাহবিচ্ছিন্না মায়ের সঙ্গে থাকে। পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধব আর প্রায়-প্রেমিক এক সহপাঠীকে নিয়ে চলতে থাকা তার নিস্তরঙ্গ জীবন ওলট-পালট হয়ে যায় এক রাতে। মধ্যরাতে চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণ করে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় তাকে। সমাজের কাছে মুখ দেখাতে না পারার লজ্জায় তার মা চান না বিষয়টা পুলিশ পর্যন্ত গড়াক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক রাকা সেনের অনুপ্রেরণায় লড়াই শুরু করে শিঞ্জিনী। ধর্ষকদের সাজা দেওয়ার লড়াই। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আবার আগের মতো করে বাঁচার লড়াই। শেষ পর্যন্ত কতটা সফল হয় সেই ‘অর্ডিনারি উওম্যানে’র ‘ডেঞ্জারাস’ লড়াই?
ধর্ষিতাকে ঘিরে তৈরি হওয়া কোর্টরুম ড্রামার কথা বললে হালফিলের দর্শকদের মনে পড়বেই ‘পিঙ্ক’ ছবিটির কথা। আর বাংলা ছবির কথা বললে অবধারিত ভাবেই এসে পড়ে তপন সিনহার ‘আদালত ও একটি মেয়ে’। আবার ছবি হিসেবে তেমন না উতরোলেও ‘মম’ ছবিটি মনে থেকে যায় গণধর্ষিতা মেয়েটির অসহায় অভিব্যক্তির জন্য। এরকম উদাহরণ কম নেই। এদেশে নারী নির্যাতন এক মহামারীর মতো বহু দিন ধরেই তার দাঁতনখে ফালা ফালা করেছে বহু নারীর চেতনা ও আত্মসম্মানকে। পরিসংখ্যান জানলে সত্যিই শিউরে উঠতে হয়। তাই বারবার সাহিত্যে কিংবা চলচ্চিত্রে এটা যে বিষয় হিসেবে উঠে আসবে সেটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু ‘বোধন’ কি সেভাবে আমাদের ছুঁতে পারে, যেভাবে ছুঁয়ে গিয়েছে এই ছবিগুলি?
সহজ ও এককথায় দেওয়া উত্তর হল, না। গল্প হোক বা অভিনয়, কোনওভাবেই যেন স্পর্শ করতে পারে না ‘বোধন’। সিরিজের টাইটেল কার্ডে যেভাবে ব-এর পাশে আকারের পরিবর্তে যেভাবে ত্রিশূলের মোটিভটি নেমে আসে, সেভাবে কিন্তু দর্শকের মনকে ফুঁড়ে দিতে পারেননি পরিচালক ও অন্য কলাকুশলীরা। বলা ভাল, মেগা সিরিয়ালের ঢঙে এগিয়েছে গল্প। যা শেষ পর্যন্ত বুঝিয়ে দেয় দ্রুত ‘প্রোজেক্ট’ নামানোর টার্গেট থাকলে এমনটাই হয়তো হওয়ার কথা।
প্রথমেই বলা যেতে পারে গল্পের কথা। গল্প আমাদের খুবই চেনা। তবু প্রথম দিকে যেভাবে সাসপেন্স তৈরি করার চেষ্টা রয়েছে তা ভাল। রাকার চোখে পড়েছিল কয়েকটি ছেলের সঙ্গে গাড়িতে বসে থাকা শিঞ্জিনীর অস্বস্তিতে ভোগা মুখ। তবু কিছু করে ওঠার আগেই সিগন্যাল লাল হয়ে যায়। গাড়িটিও চকিতে অদৃশ্য হয়। পরে রাকা জানতে পারে তাদের কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের যে ছাত্রী ধর্ষিতা হয়েছে তাকেই সে সেদিন দেখেছিল। এই পর্যন্ত গল্প বেশ ঠিকঠাকই এগোয়। মেয়েটির ক্ষতবিক্ষত মুখ, তার মায়ের অস্বস্তি, লজ্জা ও যন্ত্রণা, রাকার জেদ— দর্শক হিসেবে একটা প্রত্যাশা তৈরি হতে থাকে। কিন্তু তারপর যত সময় গড়ায় ধীরে ধীরে বোঝা যায় সেই এক স্টিরিওটাইপ গল্পই হয়ে উঠতে চলেছে ‘বোধন’।
এমনকী, একেকটি পর্বের শেষে তৈরি হওয়া কোনও মোচড়— তাও এখানে অনুপস্থিত। সব চরিত্রই বড্ড তাড়াহুড়ো করে তৈরি। দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশ অফিসার, তিন ধর্ষকদের প্রভাবশালী পরিবার, তাদের আইনজীবী, রাকার গোমড়ামুখো প্রেমিক— সবাই। আসলে চিত্রনাট্যেই রয়ে গিয়েছে গলদ। কোর্টরুম ড্রামায় যে ঘাত-প্রতিঘাত, উত্তর-প্রত্যুত্তর থাকে সেসব কই? চেষ্টা একটা ছিল। ধর্ষকদের আইনজীবী জানতে চান, মেয়েটিকে যখন পাওয়া যায়, সে নগ্ন ছিল কি না। আবার আরেক জায়গায় চান্দ্রেয়ী ঘোষ বলে ওঠেন, ‘‘চেঁচিয়ে না বললে মেয়েদের কথা অনেকেই শুনতে পান না।’’ এই মুহূর্তগুলোকে ঘিরে ‘নাটক’ তৈরি করা যেত। কিন্তু হল কই?
দুঁদে আইনজীবী তাঁর মক্কেলদের বাঁচাতে যে যুক্তি সাজান তাও চূড়ান্ত এলোমেলো। ফলে সেটা খণ্ডনও অনায়াসেই করে দেওয়া যায়। এভাবেই সিরিজ যত এগিয়েছে, গল্প তত ঝুলেছে। একেবারে শেষে একটি মৃত্যু হয় (স্পয়লারের কারণে সেটা বলা যাবে না)। কিন্তু সেই মৃত্যু তার অভিঘাতই তৈরি করতে পারে না দুর্বল কাহিনি বয়নের জন্য। একেবারে শেষে ঢাকের শব্দ শুনিয়ে রাকা সেনের মুখে ‘বোধন’ শব্দটির একটা ব্যাখ্যাও দেগে দেগে বলানো হল। যেন এইটুকু বুঝে নেওয়ার ক্ষমতাও দর্শকের নেই!
অভিনয়ে রাকা সেনের ভূমিকায় সন্দীপ্তা সেনকে (Sandipta Sen) ভাল লাগে। নির্বাক তাকিয়ে থাকা অথবা ছোট ছোট সংলাপের শানিত প্রয়োগে চমৎকার ভাবে তিনি ফুটিয়েছেন চরিত্রটিকে। চান্দ্রেয়ী ঘোষ (Chandrayee Ghosh) স্বভাবসিদ্ধ চোখা অভিনয়ে যথাসাধ্য করেছেন। কিন্তু বাকিরা সকলেই অত্যন্ত সাধারণ। সবচেয়ে হতাশ করেন দিতিপ্রিয়া (Ditipriya Roy)। তাঁর মুখে ধর্ষিতার মনের মধ্যে চলতে থাকা ঝড়ের আভাস কই? শুরুতে ‘মম’ ছবির কথা বলা হয়েছে। সেখানে ধর্ষিতা মেয়েটি না বলেও অনেক কথা বলে যায়। এখানে শিঞ্জিনীর মুখে সংলাপ রয়েছে অনেক। কিন্তু কিছুতেই যেন চরিত্রটিকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।
বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না আরও অনেক কিছুই। শিঞ্জিনীর সঙ্গে যখন রাকার দেখা হচ্ছে, তখন কি সন্ধ্যাবেলা? কারণ সে বসে রয়েছে গাড়ির অন্যদিকে। অথচ ধর্ষণের ঘটনার ঠিক আগে তাকে উলটো দিকে বসে থাকতে দেখা যায়। এই ব্যাপারটা পরিষ্কারই হয় না। ঘটনাটি তো ঘটেছিল শুনশান রাস্তায়। অথচ পার্টিতে শিঞ্জিনী ওই গাড়িতেই গিয়েছিল, তেমন কিছু তো বলা হয়নি। তাছাড়া যখন শিঞ্জিনী দেখল গাড়ির মধ্যে ছেলেগুলি অভব্যতা করছে, সে তো চেঁচিয়েই রাকাকে কিছু বলতে পারত। কেন সে চেঁচায়নি সেই ব্যাখ্যা মেলে না।
এদিকে এই সময়ে দাঁড়িয়ে এমন এক ঘটনায় মিডিয়ার ভূমিকা বলতে কেবল এক ইনটার্ন মহিলা সাংবাদিকের নিজস্ব তদন্ত? বাদবাকি কোথাও কিছু নেই? যখন কেস চলছে তখন সংবাদমাধ্যমকে তার কভারেজ করতে দেখা গেলেও সেই খবর ও জনমানসে তার প্রতিক্রিয়া, কিছুই নেই। তিন ধর্ষকের পরিবার দারুণ প্রভাবশালী, শুরুতে একথা বলা হলেও তারা আদতে কতটা প্রভাবশালী সেটা ঠিকমতো বুঝেই ওঠা যায় না। এরকম আরও অনেক কিছুই রয়েছে। তালিকা দীর্ঘ করে লাভ নেই। এককথায় বলতে গেলে ‘হইচই’ (Hoichoi) ওয়েব প্ল্যাটফর্মের এই সিরিজটি আদ্যন্ত হতাশই করে। ঠিকমতো হোমওয়ার্ক না থাকলে, সম্ভাবনাময় একটি আইডিয়ার কেমন করে ‘বিসর্জন’ হতে পারে ‘বোধন’ তার এক মোক্ষম উদাহরণ হয়ে উঠেছে।
ওয়েব সিরিজ – বোধন
অভিনয়ে – সন্দীপ্তা সেন, দিতিপ্রিয়া রায়. চান্দ্রেয়ী ঘোষ
পরিচালনা – অদিতি রায়
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.