বিশ্বদীপ দে: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এই পৃথিবীর বুকে এমন এক গভীর ক্ষতচিহ্ন, যা আজও সারেনি। সাড়ে সাত দশক পেরিয়ে এসেও সেই ক্ষত থেকে পুঁজরক্ত ঝরতে দেখা যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হোক কিংবা উত্তর কোরিয়ার খামখেয়ালি রাজা কিং জং উনের হুঙ্কার, পারমাণবিক হামলার আতঙ্ক ফিরে ফিরে আসে। আর ততবার এই আধুনিক পৃথিবীর বুকে জেগে ওঠে কবেকার নাগাসাকি-হিরোসিমা! এবং ওপেনহাইমার (J. Robert Oppenheimer)। আসলে পরমাণু বোমার কথা বলতে বসলে ‘পরমাণু বোমার জনকে’র কথাও যে আসবেই! এহেন মানুষকে নিয়ে ছবি বানাচ্ছেন ক্রিস্টোফার নোলান (Christopher Nolan), এযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক, একথা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই শুরু হয়েছিল প্রতীক্ষা। অবশেষে তা মুক্তি পেয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই সর্বত্র চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মধ্যে পড়ে গিয়েছে আলোড়ন। কেমন হল নোলানের বহুচর্চিত ছবি ‘ওপেনহাইমার’?
গত শতাব্দীর তিনের দশকের শেষ ভাগে শুরু হওয়া মহারণ গোটা দুনিয়ার ইতিহাস, সংস্কৃতি, জনজীবন সর্বত্র বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাই বারবার সেই সময়কে নিয়ে তৈরি হয়েছে ছবি। তা বলে ‘ওপেনহাইমার’ (Oppenheimer Movie) সেই তালিকার সম্প্রসারণ মাত্র নয়। ‘জিনিয়াস’ নোলানের অসামান্য নির্মাণে সত্যিই তৈরি হয়েছে এক সময়যান, অন্ধকার হলে যা দর্শককে নিয়ে ফেলে সেই অস্থির সময়ে। স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যেই গল্প সরলরৈখিক ভাবে বলেননি নোলান। কখনও সাদা-কালো, কখনও রঙিন, বিভিন্ন টাইমলাইনে গল্প এগিয়েছে। ফুটে উঠেছে ওপেনহাইমারের অন্তর্বিশ্ব।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংস ও ক্ষয়ের সবচেয়ে করুণ ছবি দু’টির একটি যদি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের হয়, অন্যটি হিরোশিমা-নাগাসাকির মাটি থেকে আকাশ ছুঁয়ে ফেলা ‘মাশরুম ক্লাউড’ তথা ছত্রাক-মেঘের। কিন্তু নোলানের ছবিটি পারমাণবিক ধ্বংসলীলাকে দেখাতে চেয়েছে একজোড়া চোখ দিয়ে। যে চোখ ওপেনহাইমারের। কিলিয়ান মার্ফির ক্লোজ শটে সেই দৃষ্টিই সবটা বলে দিতে থাকে। এই ছবি ওপেনহাইমারকে নিয়েই। তিনিই এই ছবির নিউক্লিয়াস। তাকে ঘিরে আসতে যেতে থাকে চরিত্রগুলি।
তরুণ ওপেনহাইমার ছিল তুমুল মেধাবী অথচ আদ্যন্ত ঘরকুনো এক মানুষ। যে নিজের বিছানায় শুয়ে চেতনায় ধরতে চাইত এক অদেখা ব্রহ্মাণ্ডকে। সভ্যতার বিস্তারকে ছাপিয়ে চেনা পৃথিবীকে পেরিয়ে তত্ত্বের চোখ দিয়ে সে বহু হিসেব মিলিয়ে নিতে চাইত। অথচ ল্যাবরেটরিতে সে মোটেও স্বচ্ছন্দ নয়। শিক্ষক প্যাট্রিক ব্ল্যাকেটের ধমক খেয়ে একদিন তাঁর জন্য বিষ মাখানো সবুজ আপেল রেখে আসে সে (যেটিতে প্রায় কামড় বসিয়ে ফেলছিলেন নিলস বোর)! শুরুর দিনের এই আচরণগুলিই যেন বুঝিয়ে দেয় ওপেনহাইমারের মধ্যে স্ববিরোধিতা কী পরিমাণে ছিল।
ছবিটি ৩ ঘণ্টার। বারবার বিভিন্ন সময়বৃত্তে ঘোরাফেরা করে কাহিনি। কিন্তু নোলানের অন্যান্য ছবির মতো ততটাও জটিল নয় তা অনুসরণ করা। তবে সংলাপের পর সংলাপ দাবি করে তীব্র মনঃসংযোগ। কাই বার্ড ও মার্টিন জে শেরউইনের লেখা ‘আমেরিকান প্রমিথিউস’ অবলম্বনে তৈরি এই ছবি এমনভাবে গড়ে উঠেছে, সত্য়িই মনে হতে থাকে একধাক্কায় কয়েক দশক পিছিয়ে গিয়েছে পৃথিবী। আগাগোড়াই থ্রিলারের একটা মোড়ক থাকলেও ওপেনহাইমারের মনোজগৎকেই যেন ধরতে চাওয়া হয়েছে। মাঝে মাঝেই স্ক্রিন জুড়ে ব্রহ্মাণ্ডের চলন, তারার ঝাঁক কিংবা পরমাণুর জগৎ ঝিলিক দিয়ে সেকথাই কি বুঝিয়ে দেয় না?
একসময়ের মেধাবী তরুণ থেকে বিখ্যাত বিজ্ঞানী, সেখান থেকে কার্যতই ‘রাজনীতিক’ হয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ হয়ে পড়া, তারপর ‘দেশদ্রোহী’র তকমায় বিদ্ধ হওয়ার অপমান- ওপেনহাইমারের জীবনের বিভিন্ন পর্যায় আসাযাওয়া করতে থাকে পর্দায়। তবে এর পিছনে থাকা ষড়যন্ত্রও ক্রমে উন্মোচিত হয়। এবং যে কোনও থ্রিলার ছবির মতো ক্লাইম্যাক্স ও অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্সের নির্মাণ এমনই সুচারু, ঘোর লাগতে বাধ্য। নোলান বারবার বলেছেন, এই ছবিতে কোনও ভিএফএক্স নেই। এবং থ্রিডি চশমা না পরেও ত্রিমাত্রিক হয়ে উঠবে দৃশ্যগুলি। ‘ম্যানহাটন প্রোজেক্টে’র সেই দৃশ্য, যেখানে গীতার শ্লোক আও়ডান ওপেনহাইমার, তা এই ছবির সম্পদ। শব্দ ও আলোর ঝলকানির দমকে দমবন্ধ হয়ে আসে যেন!
ওপেনহাইমারের ভূমিকায় কিলিয়ান মার্ফি অসামান্য কাজ করেছেন বললে কিছুই বলা হয় না। তাঁর দৃষ্টির কথা আগেই বলা হয়েছে। অভিব্যক্তি কিংবা সংলাপ তাতেও তিনি অনবদ্য। রক্তমাংসের বিজ্ঞানী হয়ে উঠতে যা যা করা দরকার সবই তিনি করেছেন নিপুণ ভাবে। পাশাপাশি অনেক কম জায়গা পেয়েও মাত করে দেন ওপেনহাইমারের স্ত্রী কিটির ভূমিকায় থাকা এমিলি ব্লান্ট। ছবির একেবারে শেষে স্বামীর ‘শত্রু’ এডওয়ার্ড টেলরের সঙ্গে করমর্দন প্রত্যাখ্যান করার ভঙ্গিটি মনে থেকে যাবে। ওপেনহাইমারের প্রেমিকা জিন ট্যাটলকের ভূমিকায় ফ্লোরেন্স পাঘও অনবদ্য। আইনস্টাইনের ভূমিকায় টম কন্টিও দারুণ! বাকিরাও প্রত্যেকে নিজের ভূমিকায় এতই ‘জীবন্ত’ যে বিস্মিত হতেই হয়। এবং রবার্ট ডাউনি জুনিয়র। ‘আয়রনম্যানে’র ভূমিকায় জগৎজোড়া খ্যাতি যাঁর, সেই তিনি এখানে স্বল্পকেশ, পাকা চুলের শীর্ণ বৃদ্ধের ভূমিকায়। ছবির ‘অ্যান্টিগনিস্ট’ তিনি। অভিব্যক্তির অসামান্যতায় দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে তিনি কেবলই মুগ্ধতা বুনে যেতে থাকেন।
এই ছবির আবহসংগীত, সম্পাদনাও অসামান্য। দুই ভিন্ন সময়ের ভিন্ন ‘বিচারপর্ব’ নাগাড়ে যেভাবে চলতে চলতে ছবির একেবারে ক্লাইম্যাক্সে এসে বিপুল গতি পায়, তা সামলানো যে কী কঠিন! অথচ সম্পাদনার দক্ষতা সেটাই নিখুঁত হয়ে উঠেছে। একই ভাবে আবহসংগীত ছবির সম্পদ হয়ে উঠেছে। ছবির সেরা দৃশ্য পুকুরের ধারে আইনস্টাইন ও ওপেনহাইমারের কথোপকথন। সেটিও ছবিতে একাধিক বার দেখানো হয়েছে। এর পিছনে একটা ‘রহস্য’ও রয়েছে। ছবির শেষে এসে তা পরিষ্কার হয়। তবে সব উত্তর কি মেলে? বোধহয় না। নোলানের ছবি বারবার দেখতে হয়। তবেই নতুন নতুন ব্যাখ্যার সন্ধান মেলে। যেমন একেবারে শুরুতে বৃষ্টির দৃশ্যটি। নোলানের দৃষ্টি ও সেই বৃষ্টির সঙ্গত কি আসলে চোখের জলের কথাই বলে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে বারবার ডুব দিতে হবে ছবির ভিতরে। ছবিটির আসল প্রতিক্রিয়া শুরু হয় তা দেখা শেষ হওয়ার পরে। ঠিক পারমাণবিক বিস্ফোরণের ‘চেন রিঅ্যাকশনে’র মতোই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.