বিশ্বদীপ দে: ‘বাংলা সিনেমার (Bengali movie) পাশে দাঁড়ান।’ টলিউডকে বাঁচাতে এই আরজি বেশ কয়েক মাস হল ‘ট্রেন্ডিং’। এই মুহূর্তে ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ কিংবা ‘দোস্তজী’ হইহই করে চলছে সিনেমা হলগুলিতে। যা প্রমাণ করে দিয়েছে, ভাল ছবি চিনতে দর্শক সচরাচর ভুল করেন না। শুক্রবার মুক্তি পেয়েছে আরেকটি বাংলা ছবি ‘সিটি অফ জ্যাকালস’। সুজিত দত্ত রিনো পরিচালিত এই ছবির পাশে কি দাঁড়াবে দর্শক? উত্তরটা পেতে এখনও অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু ছবির নির্মাণ কি আমাদের আদৌ আশা জাগাচ্ছে?
সেকথা বলার আগে ছবির গল্পটা সামান্য বলা প্রয়োজন। মূলত থ্রিলারের ধাঁচে তৈরি এই ছবির শুরুতেই একেবারে জোড়া খুন ঘটিয়ে দিয়েছেন পরিচালক। এক নির্মীয়মাণ বহুতলে। সেই সঙ্গে সেখান থেকে উধাও বিপুল পরিমাণ টাকা ভরতি একটি ব্রিফকেসও। যা গিয়ে পড়ে বিল্ডিংটির নির্মাণকর্মীদের হাতে। এরপর ছবির গল্প সমান্তরালে বলতে থাকে সমাজের দুই শ্রেণির কথা। এক শ্রেণিতে রয়েছেন আর্থিক ভাবে চূড়ান্ত ধনীরা। অন্য শ্রেণিতে শহরের প্রান্তিক মানুষরা। রুটিরুজির টানে অন্য জেলা থেকে যাঁরা পাড়ি জমিয়েছেন কলকাতায়। তারপর জড়িয়ে গিয়েছেন এই শহরের ধুলোধোঁয়া মাখা বিষাক্ত বাতাসের সঙ্গে। দুই শ্রেণির মধ্যে মিল একটাই। কী করে আরও বেশি টাকা রোজগার করা যায়। ঠিক রোজগারও নয়। বলা যায় যে কোনও উপায়ে কী করে আরও বেশি টাকা হাতের মুঠোয় ধরা যায়। শেষমেশ তাই ওই টাকার বান্ডিলই হয়ে ওঠে সিনেমার প্রোটাগনিস্ট। দুই শ্রেণির মানুষেরই প্রধান টার্গেট ওই বিপুল অর্থ।
ছবির শুরুতেই খুন এবং তারপর শান্তিলাল মুখোপাধ্যায় (Shantilal Mukherjee) অভিনীত পুলিশ অফিসার চরিত্রটির আগমনে রহস্য জমে ওঠে। কিন্তু তারপর যত সময় এগিয়েছে ততই যেন এলিয়ে পড়েছে গল্প। আর বিরতির পরে তা যেন আরও ঢিলে হয়ে যায়। সেই কারণে একেবারে শেষের চমক কিংবা ক্লাইম্যাক্সের গোলাগুলির দৃশ্যের আগেই দর্শক হিসেবে ছবিটি থেকে যেন সব প্রত্যাশা শেষ হয়ে যায়।
ছবির আসল ‘ভিলেন’ নিঃসন্দেহে চিত্রনাট্য। বিশদে বলা কঠিন। কেননা তা হলে ‘স্পয়লার’ এসে পড়তে পারে। তবে এটা বলাই যায়, একসঙ্গে সমাজের দু’টি শ্রেণি, অসংখ্য চরিত্রের আমদানি করাটাই হয়তো সবথেকে বড় ভুল। আর সেই কারণেই কোনও চরিত্রই সযত্নে গড়ে ওঠেনি। তাই তাদের প্রতি আলাদা করে কোনও সংযোগ যেন গড়ে ওঠে না দর্শকদের। ফলে ‘ক্যাথারসিসে’র ন্যূনতম সম্ভাবনাও মাঠে মারা যায়।
তবু এরই মধ্যে উজ্জ্বল শান্তিলালের অভিনয়। রাগী, বদমেজাজি পুলিশ অফিসারের চরিত্রটিকে তিনি অনেকটাই বিশ্বাসী করে তুলেছেন। যা করতে পারলেন না মিস্ত্রির চরিত্রে জয় সেনগুপ্ত (Joy Sengupta)। তাঁর পোশাক কিংবা বস্তির ঘর যতটাই বিশ্বাস্য হয়েছে, ততটাই ঝুলেছে চরিত্রটির জমাটি ভাব। যেহেতু তিনিই ছবির প্রধান চরিত্র, তাই এতেই ছবিটি আরও বেশি করে মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে। তাঁর সঙ্গে সায়নী ঘোষের (Saayoni Ghosh) চরিত্রটির রসায়নও স্পষ্ট হয় না যেন। সায়নী অবশ্য অভিনয়ে অনেকটাই উতরে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর মুখে ‘রাজপ্রাসাদ’ শব্দটির অভিজাত উচ্চারণ কানে লাগে। তাছাড়া চরিত্রটির বিশেষ কিছু করারও ছিল না। খরাজ মুখোপাধ্যায়ের মতো অভিজ্ঞ একজন অভিনেতাকে মাঝারি লেগেছে ছবিতে। দু-এক জায়গায় তিনি রীতিমতো ‘ভাঁড়ামি’ করে ফেলেছেন। যদিও তার দায়ও অনেকটাই বর্তায় চিত্রনাট্যকারের উপরে। তবে মৃত প্রোমোটারের ভাইয়ের ভূমিকায় দেবপ্রসাদ হালদারের অভিনয় মন্দ লাগে না।
ছবিতে ড্রোনের ব্যবহার ভাল লাগে। যেভাবে কস্টিউম ও ঘটনাস্থলকে ‘বাস্তব’ করে তোলা হয়েছে তা প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু গান ও আবহসংগীত সেভাবে কানে লাগে না। সম্পাদনাও অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। ফলে যে দৃশ্যগুলিতে চমক থাকতে পারত, তা জমে না। ‘প্রেডিক্টেবল’ মনে হতে থাকে। কেবল একের পর এক খুনের দৃশ্য দেখিয়ে যে দর্শককে টেনে রাখা সম্ভব নয়, তা বোঝা উচিত ছিল।
শেষমেশ এটা বলাই যায়, শহর জুড়ে দাপাতে থাকা শিয়ালদের আখ্যানকে জমাতে গেলে তা আরও ‘টাইট’ হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দুর্বল চিত্রনাট্য সেই সম্ভাবনাকে আগাগোড়াই খারিজ করে দিয়েছিল। বাকি কাজটা করেছে মাঝারি অভিনয় ও অযত্নের সম্পাদনা। দর্শক কি এরপরও এমন ছবির পাশে দাঁড়াবেন? সেটা তাঁদের উপরই ছাড়া যাক।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.