শম্পালী মৌলিক: যখন পৃথিবীতে প্রেম কমে আসছে ক্রমশ, হাত ধরার বদলে ফোন ধরা নিয়ে ভাবিত মানুষ, ভালবাসার মানুষকেও ফোনে দেখে, সেই সময় মানুষের ভিতরঘর দেখার কথা বলে নবাগত পরিচালক পরমা নেওটিয়ার প্রথম ছবি ‘মিথ্যে প্রেমের গান’ (Mitthye Premer Gaan)। বহিরঙ্গে বলিউড ঘেঁষা, কিন্তু ছবিতে ভালবাসার ম্যাজিকাল স্পর্শ বাঙালি দর্শককে ছুঁয়ে যাবেই। এমনই যত্নে ছবিটি বানিয়েছেন তিনি। পরমার আরও একটা পরিচয় তিনি শিল্পপতি হর্ষ নেওটিয়ার কন্যা। তবে ফিল্মমেকার হিসাবে প্রথম ছবিতেই পরমা তাঁর স্বাক্ষর রাখলেন।
নিজেকে চিনতে গিয়ে অন্য এটা মানুষকে সবটা দিয়ে ভালবাসা যায়। হোক না তার পরিণতি মেলানকলিক! পুরনো প্রেম থেকে দূরে গিয়েও কাছে আসে মানুষ, পালিয়ে গিয়েও ফিরে পেতে চায়– এ এক আশ্চর্য টানাপড়েন। সত্যি প্রেমে না পড়লে, এই দোটানার স্বাদ অনাস্বাদিতই থেকে যায়। হারানোর ভয় থেকে কেউ আবার প্রেমেই পড়ে না– এমনও হয়। কেউ আবার শঙ্কা সত্ত্বেও জড়িয়ে যায় ভালবাসায়, এসব নিয়েই ‘মিথ্যে প্রেমের গান’। গল্পের আঙ্গিক ত্রিকোণ সম্পর্কের ঠিকই, তবে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার গল্পই বলে পরমার প্রথম ছবি। নিজেকে ভাল না বাসলে কি, অন্যকে তেমন আদরে আগলে রাখা যায়? এ প্রশ্ন তোলে ‘মিথ্যে প্রেমের গান’ ছবির চিত্রনাট্য।
কাহিনি কেমন? ছবির কেন্দ্রে অভীক (অনির্বাণ ভট্টাচার্য)। অন্তর্মুখী ছেলেটা একটা বার-এ গান গায়। দারুণ লেখে। প্রতিষ্ঠিত সংগীতশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। মধ্যবিত্ত পরিবারে রয়েছে তার মা (সুদীপা বসু)। ব্লাইন্ড স্কুলে তার শিক্ষকতার সূত্রে সংসার চলে। অভীকের বাবা দুশ্চরিত্র, মাকে ছেড়ে গিয়েছে। ভাঙাচোরা পরিবারের ক্ষত তার অস্তিত্ব ছুঁয়ে, তাই সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। সঙ্গী বলতে একমাত্র বন্ধু দেব (সৌম্য মুখোপাধ্যায়)। নিঃসঙ্গ অভীক ধরেই নেয়, প্রয়োজন ফুরলে মানুষ ছেড়ে যায়। তাই প্রেমে পড়েও ভয় পায় সে।
যখন বসন্তের বাতাসের মতো অন্বেষা (ইশা সাহা) অনুপ্রবেশ করে জীবনে, ভাল লাগলেও দূরত্ব রচনা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে অভীক। অন্যদিকে অন্বেষা বুঝতে পারে আড়ালের প্রাচীর ভেঙে তারা পরস্পরের কাছে আসছে তীব্র ভাবে। কিন্তু এ মেয়ে দিশেহারা। তার বাবা হরিপদ রায় (দেবেশ চট্টোপাধ্যায়) প্রখ্যাত শাস্ত্রীয়সংগীত শিল্পী। তার যোগ্য শিষ্য আদিত্য (অর্জুন চক্রবর্তী) অন্বেষাকে ভালবাসে। তাহলে অন্বেষা কী করবে? প্রেম কি উচিত-অনুচিত-পরিণাম বিচার করে? সে এক দ্বন্দ্বের উপাখ্যান।
ক্রমশ অভীক ভাবতে থাকে আদিত্য-ই অন্বেষার যোগ্য। তার অন্যতম কারণ মার্গসংগীতে সে অত পারদর্শী নয়। ওদিকে অন্বেষা অকপট তার আদরে-আবদারে। সে অভীককে ভালবাসে। কিছুটা একমাত্রিক আদিত্য সংগীত বিষয়ে অত্যন্ত রক্ষণশীল। সহ্য করতে পারে না অভীকের উপস্থিতি। এসবের টানাপোড়নে ভালবাসার নাভিশ্বাস ওঠে। অদ্ভুতভাবে অন্বেষাকে হারানোর ভয়ে অভীক তার থেকে দূরে চলে যায়। দ্বিতীয়ার্ধে ব্যথার আগুনে অভীক তার শিল্পী সত্তা খুঁজে পায়। প্রখ্যাত রকস্টার হয়ে ওঠে। ততদিনে অন্বেষা সাংবাদিক। এবার কী হবে? অভীকের ভালবাসা কি হেরে যাবে তার ভয়ের কাছে? না কি আদিত্য বিশুদ্ধ সংগীতের রসে অন্বেষার মন এতটাই আচ্ছন্ন করবে যে অন্বেষা নিজের মনের হদিশ পাবে না? বাকিটা বড়পর্দায় দেখতে হবে।
এবার আসি অভিনয় প্রসঙ্গে। খানিক দেবদাস-ঘেঁষা অভীকের চরিত্র। নিবিড় শ্রম দিয়ে নিজের চরিত্রে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছেন অনির্বাণ (Anirban Bhattacharya)। তাঁর চরিত্রটা জটিল, তার অভিঘাত ভালই ধরেছেন অভিনেতা। তবু অনির্বাণ বলেই প্রতিবার তাঁর কাছে দর্শকের প্রত্যাশা বেশি থাকে। কারণ তিনি নিজেই তাঁর কাজ উঁচু তারে বেঁধে ফেলেছেন। অভীককে সর্বক্ষণ সঙ্গত করেছে তার একমাত্র বন্ধু বারটেন্ডার, যে একসময় তার ম্যানেজার হয়ে ওঠে– সেই দেব। নির্দ্বিধায় বলা যায় তারা পরস্পরের পরিপূরক। দেবের চরিত্রে অনবদ্য সৌম্য। তাঁদের দেখতে গিয়ে কখনও কখনও রণবীর কাপুর- ভিকি কৌশল জুটির (‘সঞ্জু’) কথা মনে পড়তে পারে। আর মনে পড়তে পারে ‘আশিকি ২’-র কথাও। অসুবিধা নেই। সুর আর ভালবাসা মিলেই এমন হয়।
ইশা (Ishaa Saha) রোম্যান্স এবং কান্না, দুই ধরনের দৃশ্যে অতুলনীয়। আর মেকআপ প্রায় নেই তাঁর। পরিচালক পরমা দারুণভাবে ইশার চোখ ব্যবহার করেছেন। অনির্বাণ আর ইশার রসায়ন ভাল লাগে। অর্জুন (Arjun Chakraborty) গ্রে শেডেও প্রচণ্ড ভাল অভিনয় করেছেন। ছবিতে অন্বেষার মন কী চায় সেটা আরও গুরুত্ব পেলে ভাল হত। ছবির দৈর্ঘ্য একটু কম হতে পারত। মিউজিক্যাল ছবির সুর করেছেন রণজয়, কুন্তল, সৌম্য ঋত ও ঈশান। ভালই মিউজিক। মনে থেকে যায় ‘নীরবতায় ছিল প্রশ্ন তোমার’ গানটা। ছোট ছোট চরিত্রে অনুষা বিশ্বনাথন, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, সুদীপা বসু চমৎকার। সবমিলিয়ে পরমা নেওটিয়ার প্রথম ছবি ভালবাসার অনেক স্মৃতি ফিরিয়ে দিল।
সিনেমা – মিথ্যে প্রেমের গান
অভিনয়ে – অনির্বাণ ভট্টাচার্য, ইশা সাহা, অর্জুন চক্রবর্তী, সৌম্য মুখোপাধ্যায়, অনুষা বিশ্বনাথন, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, সুদীপা বসু
পরিচালনায় – পরমা নেওটিয়া
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.