নির্মল ধর: সুইস নাট্যকার ফ্রেডরিক ডুরেনম্যাটের (Friedrich Dürrenmatt) ‘দ্য ডেঞ্জারাস গেম’ নিয়ে কিছুদিন আগেই এই শহরে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ‘প্লে হাউস’ নামে একটি নাটক প্রযোজনা করেছিলেন। রুমি জাফরির নতুন ছবি ‘চেহরে’ (Chehre Movie) দেখতে বসার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সেই নাটকটির কথা মনে পড়ছিল। শোনা যায়, ফ্রেডরিক ডুরেনম্যাটও নাকি আবার গি দ্য মোপাসাঁর (Guy de Maupassant) ছোট গল্পের অনুপ্রেরণায় ‘দ্য ডেঞ্জারাস গেম’ লিখেছিলেন। হতেই পারে! তবে রুমি জাফরির চিত্রনাট্য পুরোপুরি ভারতীয় পরিমণ্ডলে এনে ফেলেছে গল্পটিকে।
অবশ্য, ছবির পরিমণ্ডলটিই শুধুমাত্র ভারতীয়, ছবির চেহারা ও চরিত্র পুরোটাই বিদেশি ঢংয়ে বাঁধা। তাই গল্পের সঙ্গে দর্শকের কোনও যোগাযোগই কখনও গড়ে ওঠেনি। পাহাড়ে ঘেরা নির্জন জায়গাটি নাকি দিল্লি শহর থেকে মাত্র দু-আড়াইশো কিলোমিটার দূরে। একটি সুদৃশ্য কাঠের সাজানো বাংলা বাড়িতে প্রতিদিন সান্ধ্য আড্ডায় জমায়েত হন চারজন বিচার বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত মানুষ। একজন বিচারপতি জগদীশ (ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়), পাবলিক প্রসিকিউটর লতিফ(অমিতাভ বচ্চন), ডিফেন্স কাউন্সিল ভূল্লার (অন্নু কাপুর) এবং বিচিত্র এক বাঁশিওয়ালা হরিয়া জাটভ (রঘুবীর যাদব)। তাঁরা কোনও কোনও দিন আজব খেলা খেলেন। হঠাৎ কোনও অতিথি পেলে তাকে নিয়ে বিচিত্র এক নকল আদালত বসিয়ে সেই নবাগত অতিথির বিচার করা হয়। বাদী-বিবাদী পক্ষের বক্তব্য শুনে রায় দেন নকল এজলাসের বিচারপতি।
এই চার মূর্তির মাঝে অতর্কিতে এক সন্ধ্যায় এসে পড়ে পথ হারানো যুবক সমীর (ইমরান হাশমি)। পেশায় বিজ্ঞাপন জগতের মানুষ। সে নাকি উচ্চাশার কারণে নিজের বসকে খুন করেছে। আবার বসেরই সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম করে। সুতরাং সমীরের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ তুলে এক ধরনের নকল বিচারসভা বসে। বাইরে তখন তুষারপাতের সঙ্গে ঝড় বৃষ্টির তাণ্ডব! পাবলিক প্রসিকিউটর, ডিফেন্স কাউন্সিল এবং নকল অপরাধী সমীরের সঙ্গে চলতে থাকে ক্লান্তিকর অতি দীর্ঘ বাক চাতুরির খেলা।
চার দেয়ালের বাইরের মশলা ঢোকানোর জন্য পরিচালক চেম্বার নাটকের ছক ভেঙে ফ্ল্যাশব্যাকে নিয়ে যান গল্পকে। বসের সুন্দরী স্ত্রীর (ক্রিস্টাল ডি’স্যুজা) সঙ্গে নাচ-গান, কিছু খুচরো ঘনিষ্ঠতার দৃশ্য জুড়তেই হয়। প্রতিশোধ, হিংসা, চক্রান্তের নাটক তৈরিও করতে হয় ডুরেনম্যাটের গল্পকে বাদ দিয়ে। ছবির ক্লাইম্যাক্স ঘটে যখন বিচারপতি সমীরকে খুনের অপরাধে ফাঁসির শাস্তি দেন। তার আগে বেশ দীর্ঘ সংলাপে দেশের নানা ধর্ষণ, খুন, সন্ত্রাসের ঘটনার কথা তুলে বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে বিচারপতি ও প্রভাবশালীদের বিচারের নামে লুকোচুরির খেলার বিবরণ দেন। সেটা অনেকটাই যেন মেঠো বক্তৃতা হয়ে ওঠে।
তপন সিংহ ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ নামের ছবিতে আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেই এসব কথা বলেছেন। আমাদের আদালত অপরাধীকে ‘জাস্টিস’ দেয় না, দেয় ‘ভারডিক্ট’। বিচারের বদলে মেলে আদেশ। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে চার বৃদ্ধের নকল এজলাস। পরিচালক ফ্রেডরিক ডুরেনম্যাটের মূল বক্তব্যকে অনেকাংশে বিকৃত করে শুধু ‘নাটক’ই বানিয়েছেন অমিতাভ বচ্চন (Amitabh Bachchan) ও ইমরান হাশমির (Emraan Hashmi) সুবিধের জন্য। অবশ্য দু’জনেই একে অন্যকে টেক্কা দিতে ছাড়েননি। অন্নু কাপুরও সঙ্গ দিয়েছেন। তবে বেচারি অবস্থা হরিয়া জাটভের (Raghubir Yadav) চরিত্রে রাঘুবির যাদবের। প্রায় সংলাপহীন চরিত্র। তারই মধ্যে কয়েকটি তীব্র অথচ শান্ত চাউনিতেই অভিনেতা বুঝিয়ে দিয়েছেন নিজের ক্ষমতা।
আসলে ‘চেহরে’ নামের এই ছবি তুলে এনেছে আমাদের বিচার পদ্ধতি ও বিচার ব্যবস্থার প্রকৃত চেহারা। চারটি চরিত্রের কৃতকর্ম দেখিয়ে। তাতে কি আর গাফিলতির এই গন্ধমাদন পর্বতকে টলানো সম্ভব? প্রয়াত সুশান্ত সিং রাজপুতের প্রেমিকা রিয়া চক্রবর্তী (Rhea Chakraborty) একটি ছোট্ট চরিত্রে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতিটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। অমিতাভ ও ইমরান ছাড়া এই ছবির পাওনা এটুকুই!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.