নির্মল ধর: আর্জেন্টিনার পরিচালক পাবলো সিজার আমাদের কাছে একেবারে অপরিচিত নাম নয়। বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের দৌলতে এই শহরে বসেই ‘অ্যাফ্রোদিতা, এল জারডিন দে লো পারফিউমে’, ‘ওরিলাস’ নামের কয়েকটি ছবি দেখেছি। আফ্রিকার নামিবিয়া, টিউনিশিয়া, মরোক্কয় গিয়েও ছবি করেছেন। ভারতের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় (ভারতীয় প্রযোজন সূরজ কুমার) তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘থিঙ্কিং অফ হিম’ (Thinking of Him)। পাঁচ বছর লেগে গেল ছবিটি মুক্তি পেতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (Rabindranath Tagore) শেষ বয়সে আর্জেন্টিনার সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ তথা রবীন্দ্রপ্রেমী তরুণী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর (Victoria Ocampo) সঙ্গে বন্ধুত্ব, সখ্যতা আর স্বার্থহীন ভালবাসার গল্প নিয়েই এই ছবি। পেরু যাওয়ার পথে বুয়েনস আইরিসে পৌঁছে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন গুরুদেব। সেই সময় ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বাড়িতে আতিথ্য বরণ করেন তিনি। সেখানে প্রায় দু’মাস ছিলেন কবি। ভিক্টোরিয়ার সেবা ও সাহচর্যে কবিগুরু সুস্থ হয়ে ওঠেন। ভালবেসে গুরুদেব ভিক্টোরিয়ার নাম দিয়েছিলেন ‘বিজয়া’। ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশ্যেই লিখেছিলেন একটি কাব্যগ্রন্থ্য (পূরবী)।
পাবলোর চিত্রনাট্য দু’জনের অসমবয়সী সম্পর্কের মধ্যে ‘শরীরী’ বিষয় একেবারে আনেনি। দূর থেকে দেবতার আসনে বসিয়ে ভিক্টোরিয়া ও গুরুদেবের আন্তর্জাতিক, সামাজিক ভাবনা, প্রকৃতির সঙ্গে কবিতার যোগাযোগ, জীবনের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে। শুধু দু-তিনবার আবেগাপ্লুত হয়ে একে অন্যকে আলিঙ্গন করেছেন মাত্র। আর বিদায়বেলায় জাহাজে ওঠার আগে কপালে একটি স্নেহচুম্বন মাত্র।
কবিগুরু এবং ভিক্টোরিয়ার এই শরীরহীন ভালবাসা ছাড়া সাম্প্রতিক আর্জেন্টিনার এক তরুণ স্কুলশিক্ষক ফেলিক্সের শান্তিনিকেতনে এসে গুরুদেবের শিক্ষা ও পঠন-পাঠন পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কল্পিত গল্প জুড়ে দিয়েছেন। ফলে বারবার অতীত আর বর্তমানে ঘুরতে গিয়ে ছবির গতি ও ছন্দ ব্যহত হয়েছে। একটি কমলি (রাইমা সেন) নামের চরিত্র এনে শান্তিনিকেতনের জঙ্গলে হাতি দেখিয়ে মূল কাহিনির কোনও বাড়তি সংযোজন বা মাত্রা বৃদ্ধি হল না। পরিবর্তে সিজার যদি স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়া ভিক্টোরিয়ার একাকীত্ব, তাঁর সাহিত্যপ্রীতির কথা আরও বিস্তৃত ভাবে বলতে পারতেন কিংবা প্লাটা নদীর ধারে বসিয়ে কিছু সংলাপহীন, শব্দহীন স্মরণীয় মুহূর্ত আনতেন তাহলে দু’জনের সম্পর্কের রসায়নটি আরও পরিষ্কার হতে পারত।
আর সবচেয়ে অমার্জনীয় ত্রুটি পাবলো করেছেন কবিগুরুর মৃত্যু সংবাদ বুয়েনস আইরিসে রে়ডিও মারফত ওকাম্পোকে শুনিয়ে। তারপরই একটি রবীন্দ্রসংগীতের শোনানোর ঘোষণা হয়। বাজানো হয় বৈষ্ণবগীতি “হৃদ মাঝারে রাখবো ছেড়ে দেবো না…” গানটি। যদিও বুয়েনস রেডিও ১৯৪১ সালে ভুল করে থাকে, সেটি শুধরে নেওয়া উচিত ছিল পাবলোর। ভারতীয় কলাকুশলীরাই বা তাঁকে কিছু বলেননি কেন!
মূল দু’টি চরিত্রে ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় (Victor Banerjee) এবং এলিওনোরা ওয়েক্সলার (Eleonora Wexler) ভালই অভিনয় করেছেন। ভিক্টরের রূপসজ্জায় (রুমা সেনগুপ্ত) তাঁকে বয়স্ক রবীন্দ্রনাথ হিসেবে দিব্যি মানিয়ে গিয়েছে। রাইমা (Raima Sen) সাবলীল হলেও হেক্টর বোর্দিনি বেশ আড়ষ্ট। চিত্রনাট্যের মূল সঠিক না হওয়ায় পাবলোর আন্তরিক প্রচেষ্টার তেমন সুফল দেখা গেল না।
ছবি – থিঙ্কিং অফ হিম
অভিনয়ে – ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, এলিওনোরা ওয়েক্সলার, রাইমা সেন, হেক্টর বোর্দিনি
পরিচালনায় – পাবলো সিজার
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.