নির্মল ধর: প্রোফেসর শঙ্কু এই প্রথম পর্দায়। তাও আবার বড়পর্দা। সুতরাং আগ্রহ, ঔৎসুক্য, উত্তেজনা, সব মিলিয়ে সংযুক্তকে দেখার জন্যই সন্দীপ রায়ের এই প্রথম প্রয়াস নিয়ে দর্শকও বেশ উদ্দীপ্ত। শুরু থেকেই সন্দীপ বলেছেন, শঙ্কু বানানোর প্রথম বাধা ছিল কম্পিউটর গ্রাফিক্সের উন্নতমানের কাজ। সেই বাধা পেরিয়ে পর্দায় আনা হল শঙ্কুকে। কম্পিউটর গ্রাফিক্সের কাজে তিনিও খুব একটা অসন্তুষ্ট নন। কিন্তু দর্শক কি তুষ্ট হতে পারলেন? হলিউড, বলিউডের বহু ছবিতে কম্পিউটর গ্রাফিক্সের অত্যাধুনিক কেরামতির তুলনায় ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও এল ডোরাডো’র কাজ তেমন চোখ টানতে পারল কি?
অবশ্য কতটুকুই বা ছিল! বল লাইটনিং, অ্যানাকোন্ডার উপস্থতি, অস্তিত্বহীন সোনার শহর দেখানো, নকুড় বিশ্বাসের দিব্যদৃষ্টিতে অতীত দেখার কৌশল! এই স্বল্প পরিসরে সন্দীপ রায় ব্রাজিলের বৃষ্টি জঙ্গল। আমাজন নদের শাখা-উপশাখার অন্দরমহল, চুকামাহাই উপজাতিদের অকস্মাৎ আক্রমণের সঙ্গে কম্পিউটর গ্রাফিক্সের ব্যবহারকে সুন্দর, মসৃণভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন।
সত্যজিৎ রায়ের জনপ্রিয় এই গল্পের প্রতিটি বাঁক ও মোচড় দর্শকের জানা। শুধু দেখার ছিল- তিনি (সন্দীপ) কীভাবে শঙ্কুর দিনলিপিটি সাজান। ছবির শুরুতেই সুন্দরবনে এক অগ্নিপিণ্ড পড়ার কাহিনিজুড়ে তারক নামে এক লেখকের শঙ্কুর ডায়রি খুঁজে পাওয়ার ঘটনা জুড়ে দিয়েছেন। ধ্বংস স্তুপের মাঝে পড়ে থাকা ডায়রিটি অমন অক্ষত এবং পরিপাটি কেন, কোনও খুদে দর্শক তুলতেও পারে। কিন্তু তারপর থেকে গল্প যত এগিয়েছে, এই প্রশ্নও এগিয়েছে। সত্যজিতের গল্পের বিন্যাস অনুযায়ী ডায়রির বর্ণনা অংশগুলোর নাট্যরূপ যথেষ্ট কৌতূহল এবং রহস্য রেখেই দেওয়া হয়েছে। তবে সেই রহস্য ও উত্তেজনার মুহূর্তগুলো আর একটু বেশি ফটোজেনিক্যাল ‘নাটকীয়’ করে তুলতে পারলে বেশ সমজদার ও জমাটি হতো।
বুঝতেই পারছি কম্পিউটর গ্রাফিক্স করার আর্থিক অসুবিধা হয়তো ছিল। বাজেটের সীমাবদ্ধতা সন্দীপকে বেঁধে দিয়েছিল। না। সেজন্য শঙ্কুর প্রদর্শন বিফলে যাবে না। ব্যবসায়ী ব্লুমগার্টনের খলনায়কিপনা, সেক্রেটারি লোবোর বিশ্বাসঘাতকতা, সন্ডার্স ও ক্রোলের সৎসঙ্গ, সচিব সেজে মারড়দাবাসী নকুড় চন্দ্র বিশ্বাসের উপস্থিত বুদ্ধির জোর এবং কৌশলীপনা এবং সবার উপরে বিজ্ঞানী আবিষ্কারক প্রোফেসর শঙ্কুর নিজের আবিষ্কারের প্রতি সম্মান ও মোহহীন দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞানকে ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে পরিণত করতে না দেওয়ার স্থির সিদ্ধান্ত- এইসব মিলিয়ে সন্দীপ রায় শিশু কিশোর দর্শকের মন জয় করা ছবিই বানিয়েছেন প্রথম শঙ্কুকে। মেদহীন চিত্রনাট্য বড্ড বেশি মূলানুগ বলবেন কেউ হয়তো। বলতে পারেন অ্যাডভেঞ্চার ও অ্যাকশান মুহূর্তগুলো আর একটু দীর্ঘ হতেও পারত। কিন্তু ওই যে বাজেটের সীমাবদ্ধতার শেকল পায়ে বাঁধা। নইলে সাও পাওলো বা ব্রাজিলিয়া শহরটার ভিতর তাঁর ক্যামেরা কি আরও একটু ঘুরতে পারত না? এই ছবিতে আরও একটি কাজ অন্যরকমভাবে বসানো। সন্দীপ রায়ের আবহসৃজন। বোঝা গেল- তিনি শঙ্কুর জন্য একবারে অন্য থিম মিউজিক ভেবে রেখেছেন।
ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের মেকআপ সত্যজিৎ রায়ের আঁকা ছবির প্রতিলিপি। অভিনয়েও তিনি যেমন স্বাভাবিক, সংযত, ব্যক্তিত্বময়; তেমনই জীবন্ত। শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের নকুড় বিশ্বাস কমেডির ছোঁয়ায় অনন্য। এঁরা দু’জনেই মাতিয়ে রাখেন সারাক্ষণ। সাহেব অভিনেতাদের প্রত্যেকেই চরিত্রানুযায়ী কাজ করছেন। বিশেষ করে ব্লুমগার্টেন ও লোবো চরিত্রের দুই শিল্পী। শমীক হালদারের সাবলীল চিত্রগ্রহণ ও সুব্রত রায়ের মসৃণ সম্পাদনা ছবিটিকে গতিময় ও ছন্দোবদ্ধ করেছে। সন্দীপ বুঝিয়েই দিলেন আর্থিক সহায়তা পেলে তিনি ভবিষ্যতে আরও শঙ্কুর কাহিনিতে হাত রাখতে পিছপা হবেন না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.