প্রিয়ক মিত্র: বাংলা ভূতের গল্পের একটি সংকলন করেছিলেন সুকুমার সেন এবং সুভদ্রকুমার সেন, নাম দিয়েছিলেন ‘উপছায়া’। ভূতের বিষয়ে এটিই বোধহয় উপযুক্ত শব্দবন্ধ। ছায়ার সঙ্গে যা জুড়ে থাকে, পুরোপুরি ছায়া না হয়েই। ভূত আছে কি না সে তর্ক থাক, তবে কোনও এক অজানিত উপছায়াকে ভয় পেতে কে না ভালবাসে! সেই ভয়কে হলিউডি হরর বা বলিউডের চেনা ছকের হররে সযত্নে লালন করা হয়েছে।
কিন্তু ‘নেটফ্লিক্স’-এর ‘ঘোস্ট স্টোরিজ’-এর চারজন পরিচালকের মধ্যে অন্তত তিনজন চিরাচরিত উপায়ে দর্শককে ভয় পাওয়াতে আদৌ চাননি। এর আগে জোয়া আখতার, অনুরাগ কাশ্যপ, দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং করণ জোহর বানিয়েছিলেন ‘লাস্ট স্টোরিজ’। ভারতীয় যৌনতার নানা চোরাগলিকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছিল সেই অ্যান্থোলজি। এবার ‘ভূত’- এই বিষয়টিকে চারজন চার রকম ভাবে নিয়ে এসেছেন চারচৌকো পর্দায়। ওয়েবের সুবিধে এবং সমস্যা হল, দর্শক দেখার সময়সীমা নিজেরাই নির্ধারণ করে নেয়।
ফলে, অ্যান্থোলজি দেখার যে নিয়ম, টানা চারটি গল্প, চারটি ভাবনা, চার রকমের চলচ্চিত্রভাষার সঙ্গে পরিচিত হয়ে কোনও একটি সিন্থেসিসে পৌঁছনো- এমনটা সব দর্শক অনুসরণ না-ও করতে পারেন। ফলে, প্রত্যেক পরিচালকের ছবি দেখার অভিজ্ঞতাকে আলাদা করেই দেখা প্রয়োজন।
শুরুতে জোয়া আখতারের ছবি। ‘লাস্ট স্টোরিজ’-এ যাঁর ছবি সবথেকে প্রশংসিত হয়েছিল নেটিজেন এবং সমালোচকদের মধ্যে। সেই কারণেই বোধহয় প্রত্যাশার পারদও ছিল চরমে। এক বৃদ্ধা- জনৈক মিসেস মালিক, তার নবাগত নার্স সমীরা, তার না দেখা ছেলে এবং সমীরার প্রেমিক গুড্ডু, যে বিবাহিত, এবং একটি ফাঁকা পুরনো ফ্ল্যাট, এই ক’জনকে নিয়ে এই ছবিটি। বারবার ফাঁকা ফ্ল্যাটের দরজায় কড়া নাড়ার আগেই তা বৃদ্ধার অলৌকিকভাবে টের পাওয়া, এবং দরজার বাইরে কারও না থাকার ঘটনা পরিচিত ভূতের গল্পের কথা মনে করালেও এখানে রয়েছে চমক। তবে ভূত কোথায়, এই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে রেখে শেষে যেভাবে ভূত হাজির করেন জোয়া, তা যারপরনাই হতাশ করে। তবে, জোয়ার ‘লাস্ট স্টোরিজ’-এর ছবিটির মতো এখানেও নারীপ্রশ্ন রয়েছে তীব্রভাবে। এই ছবির মূল দুই নারীচরিত্র, যারা দু’জনে দুই শ্রেণি অবস্থানে, অপেক্ষা করছে কোনও না কোনও পুরুষের জন্য। সেই পুরুষ তাঁদের অপেক্ষার মর্যাদা দেয় কি? বৃদ্ধা মিসেস মালিক তাই একবার বলেন, ‘জীবন-যৌবন অবশিষ্ট থাকলে আমি আর কারও জন্য অপেক্ষা করতাম না।’ ছবিতে সুরেখা সিক্রি এবং জাহ্নবী কাপুর একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছেন অভিনয়ে।
অনুরাগ কাশ্যপের এক কালের গুরু রামগোপাল ভার্মা। ‘সত্য’-এর মতো ছবি তাঁকে অনুপ্রাণিত করলেও, রামগোপাল ভার্মার ‘ভূত’ তাঁকে মোটেই অনুপ্রাণিত করেনি। কারণ, তেমন অনুপ্রেরণা থাকলে হিচককীয় ঢঙে ঢেলে দিতেন না তাঁর বানানো সম্ভবত প্রথম হররটিকে। যে অনুরাগ এককালে ‘নো স্মোকিং’ বানিয়েছেন, সাইকোলজিকাল থ্রিলার বা হরর জ্যঁরটিতে তাঁর মুনশিয়ানা প্রশ্নাতীত। কিন্তু, সমস্যা হল হরর এলিমেন্ট মাথায় রেখেও যে ছকে বাঁধা ভূতের গল্প না বলে থাকা যায়, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি অনুরাগ। তাঁর মতো বড়মাপের পরিচালকের থেকে যা যা প্রত্যাশা করা যায়, তা রয়েছে ছবিতে। সিনেম্যাটোগ্রাফিতে এক আশ্চর্য আধিভৌতিক মালিন্য, সম্পাদনায় একটা প্রয়োজনীয় নিশ্চলতা, যা সময়বিশেষে দর্শককে আচ্ছন্ন করে ফেলে, এসবই অটুট। সমস্যা হল, সব মিলিয়ে কোনও প্রভাব পড়ল না।
মূল চরিত্র নেহা ছোটবেলায় পাখির ডিম ফোটার আগেই তা নষ্ট করে বহু পক্ষীশাবকের জীবন নষ্ট করত। তার বোন মারা যাওয়ার পর তার বোনপোর দায়িত্ব নিয়েছে সে। এখন সে অন্তঃসত্ত্বাও বটে। কিন্তু তার মাসির স্নেহ কোনওমতেই আরেকজন নবজাতক পাক, এমনটা চায় না বাচ্চাটি। তার আঁকা ছবিতে মাসির গর্ভ কালো হয়ে যায়। এই গল্প কোথায় গিয়ে পৌঁছয়, তা দর্শক দেখবেন। কিন্তু হলি-বলির হররের চেনা জাম্পস্কেয়ার না থাকলেও, ভয়ের একটা রেশ তো থাকবেই, যা এখানে অনুপস্থিত। হিচককের ‘বার্ডস’ বা রোমান পোলানস্কির “রোজমেরি’স বেবি” যেমন মনস্তাত্ত্বিক হরর হয়েও শিহরণ জাগাতে ব্যর্থ নয়। ভারতীয় ছবির ক্ষেত্রে দেখলে রাধিকা আপ্তে অভিনীত ‘ফোবিয়া’ ছবিটির কথা মনে পড়তে পারে এ প্রসঙ্গে। ইশা লুথরার চিত্রনাট্যের দুর্বলতাও এক্ষেত্রে জরুরি। এ ছবির প্রাণভোমরা হয়ে দাঁড়ায় শোভিতা ধুলিপালার নির্লিপ্ত অথচ মোহময় উপস্থিতি। তাঁর চোখের ভেতর দিয়ে যে অভিনয়-ভাষার চলাচল, তা ভারতীয় নায়িকাদের মধ্যে বিরল। তাঁর স্বামীর চরিত্রে সাগর আর্য, নিশ্চুপে অসামান্য কাজ করেছেন। বাচ্চাটির ভূমিকায় জাকারি ব্রজকে একটু অস্বচ্ছন্দ লাগে।
এই ছবির আসল তাস দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি একটা ম্যাজিক ঘটিয়ে ফেলেছেন, ভাবনায় এবং কাজে। ‘লাভ সেক্স অউর ধোঁকা’, ‘খোসলা কা ঘোসলা’-র দিবাকরকে স্বমহিমায় পাওয়া গেল। যিনি জানেন, সংলাপের আধিক্যর থেকে অনেক বেশি জরুরি মুহূর্ত নির্মাণ, চরিত্র নির্মাণ। রঞ্জন পালিতের ক্যামেরার সাহায্যে প্রথমেই যে কাকতাড়ুয়াটিকে আবছায়া ল্যান্ডস্কেপে ধরলেন দিবাকর, তা চমৎকৃত করে দিল।
জোয়া একটি মৃত কাকের ইমেজারি ছবির প্রথমেই দিয়ে সমগ্র অ্যান্থোলজির যে মেজাজটি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, তা ঘটল এই তৃতীয় ছবিতে এসে, দিবাকরের হাত ধরে। ছোট গ্রামে আসা এক সরকারি কর্মী, দু’টি বাচ্চা, এবং আচমকা নরখাদক হয়ে ওঠা কয়েকটি চরিত্রের সমাহারে গল্প এগোল। বাচ্চা মেয়েটির বাবা সদর থেকে এসেছেন, এবং তিনিই এই নরমেধ যজ্ঞের মূলে। তাকে যে চেহারায় হাজির করেন দিবাকর, তা অস্বস্তি দেয়। কিন্তু সঠিকভাবে অস্বস্তি দিতে পারে যে ছবি, তা দেখে তৃপ্ত না হয়ে উপায় নেই। ‘যারা অন্যদের খায়, তাদের কেউ খায় না’- এই সংলাপটি রাজনৈতিক তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে লহমায়। ছবিজুড়ে আগন্তুকের ভূমিকায় সুকান্ত গোয়েলকে বেশ লাগে, তবে মূল চমক আদিত্য শেট্টি, ইভা অমিত পরদেশি- এই দুই নাবালক অভিনেতা। আর না-মানুষী মেক আপের আড়ালে হোক, বা শেষের কয়েক মুহূর্তের অবিশ্বাস্য অভিনয়ে গুলশন ডেভাইয়া হাড় হিম করে দেন। এই অ্যান্থোলজি দেখতে গিয়ে প্রথমবার বোধহয় শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নামে দিবাকরের সৌজন্যে। এর চেয়ে বেশি কথা এ ছবি নিয়ে বলা নিরর্থক। গল্পের গঠন, চরিত্রের গঠন, মূল ভাবনা, নির্দেশনা- সব মিলিয়ে ‘ঘোস্ট স্টোরিজ’-এর সেরা কাজ দিবাকরের।
এরপরে যা ঘটে, তা-ও মোটেই কম ভৌতিক নয়। আচমকা একটি নির্জন বাড়িতে ভারতীয়দের প্রিয়তম প্রতিষ্ঠান বিয়ে এবং একটি ভূত, বা অজস্র ভূত- এসব নিয়ে একটি বিজাতীয় সার্কাস শুরু হয়ে যায়। ওয়েডিং হরর বলে যদি কোনও জঁর হয়, তাহলে তার হাস্যকরতম রূপায়ণ ঘটালেন করণ জোহর। হরেক্স বি গ্রেড-কে অনায়াসে এর চেয়ে বেশি নম্বর দেওয়া যায়। এক নবদম্পতির যৌনজীবনের পাকা ধানে মই দিয়ে এক বৃদ্ধা দিদা রোজ রোজ সেই যুগলের সংগমের তুঙ্গ মুহূর্তে গুডনাইট বলতে আসেন কেন, তা ভেবে কূল পাওয়া গেল না। নববধূটি দুষ্টুমি করে সেই দিদার লাঠিটি খাটের তলায় লুকিয়ে রাখলে তবে তার কপালে যৌনসুখ জোটে। কিন্তু এতে রেগে গিয়ে সেই ‘গ্র্যানি’ গোটা পরিবারকে সেই নববধূকে খুন করার সুপারি দিয়ে দেন কেন, তা-ও বোঝা দুষ্কর। অশরীরীর পক্ষে তো ওই লাঠিটি খাটের তলা থেকে কেড়ে কিঞ্চিৎ নাচিয়ে অবিশ্বাসী নতুন কনেকে ভয় দেখিয়ে দেওয়া সহজ ছিল। এ ছবির মূল অভিনেত্রী ম্রুনাল ঠাকুরকে দেখতে ভাল লাগে, বাদবাকি ছবিটি নির্দেশনায়-অভিনয়ে গুরুত্বহীন। ‘কভি খুশি কভি গম’-এর হরর ভার্সন বলা যেতে পারে।
শেষের আগে বলার, এ ছবির টাইটেল কার্ডটিকে একটি পৃথক হরর অ্যানিমেশন হিসেবে দেখা যায়, সঙ্গে সমীর উদ্দিনের অসামান্য আবহসংগীত। মুগ্ধ করে দেওয়ার মতো অ্যানিমেশন। হায়াও মিয়াজাকির ‘স্পিরিটেড অ্যাওয়ে’ মনে পড়ে যেতে পারে একঝলক।
ভারতীয়দের ভূতের ধারণায় ‘অ্যানাবেল’-এর পুতুলখেলা নেই (সত্যজিৎ রায়ের ‘ফ্রিৎস’-এর হাড়হিম করা পুতুলটির কথা মাথায় রেখেই বলা যায়), ‘কনজিউরিং’-এর ভূত তাড়ানো নেই, ‘ইট’-এর জোকার ভূত নেই। ‘ঘোস্ট স্টোরিজ’ সবকিছুর পরেও ভারতীয় ভূতের ধারণাটিকে কোথাও যেন ছুঁতে পারে না। যা সফলভাবে পেরেছিল ‘স্ত্রী’।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.