Advertisement
Advertisement
Shesh Pata Review

Shesh Pata Review: নারী-পুরুষের সম্পর্ক, সংশয় আর তৃষ্ণার গল্প ‘শেষ পাতা’, ছবিতে অকল্পনীয় প্রসেনজিৎ

মুগ্ধ করেছেন গার্গী রায়চৌধুরী।

Prosenjit Chatterjee and Gargi Roy Chowdhury are gems of Shesh Pata | Sangbad Pratidin
Published by: Suparna Majumder
  • Posted:April 14, 2023 8:21 pm
  • Updated:April 15, 2023 5:06 pm  

রঞ্জন বন্দ‌্যোপাধ‌্যায়: অতনু ঘোষ পরিচালিত সদ‌্যমুক্ত ‘শেষ পাতা’-র নায়িকা মেধার চরিত্রে গার্গী-র নিজের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার জ্বলেনি আলো…’ গানটি অব‌্যর্থ আকুতিতে ক্রমশ হয়ে ওঠে এই ছবির অনেক আলোর একটি, অর্জন করে পৃথক ও প্রবুদ্ধ পরিসরের গৌরব! গার্গীর গান আমি অনেক বছর আগে অনেক শুনেছি। এবং যুগপৎ মুগ্ধ ও মগ্ন হয়েছি। মঞ্চে উপচে-পড়া গার্গীর গান মনে থাকবে না, সে কি সম্ভব? কিন্তু তাজ বেঙ্গলের পুলসাইডে গার্গীর অমল রবীন্দ্র সংগীত আমার স্মৃতিতে এখনও পালতোলা তরণী। সেই কুহকী কণ্ঠকে পরিচালক অতনু মুড-রচনার কী অপরূপ মার্জনায় কাজে লাগিয়েছেন ‘শেষ পাতা’-র লেখক প্রোটাগনিস্ট বাল্মীকির (চরিত্রে প্রসেনজিৎ) বাড়িতে নিবিড় এক সন্ধেবেলার দৃশ‌্যে।

Shesh Pata

Advertisement

তুলনাহীন মাতাল, মতিচ্ছন্ন, ঋণজর্জর, দুর্বিনীত অথচ কোমল প্রসেনজিৎ এবং স্নিগ্ধ, শান্ত, গভীর গার্গীর মুখোমুখি বসে থাকার একাকিত্ব, নির্জনতা, অথচ পরস্পরকে ক্রমশ ছুঁয়ে ফেলা। প্রসেনজিৎ (লেখক বাল্মীকি) উঠে যায় গার্গীর পিছনে। গার্গী কাউচে বসে গাইছে নিমীলিত নিবেশে। প্রসেনজিৎ কুণ্ঠিত অথচ আশঙ্কা-তাড়িত হাত রাখে আশীর্বাদের বিরোধাভাসে। তারপর গ্রিক ট্রাজেডির ‘কোরিক’ চরিত্রের নিয়তি-নির্জিত কণ্ঠে বলে, ‘পালাও, না হলে বিপদে পড়বে।’ তুলনীয় দৃশ‌্য বাংলা ছবিতে মনে পড়ছে না।

এই সেই নিদারুণ রোম্যান্টিকতা, যা মৃত‌্যুর প্রতিভাস বহন করে, ধ্বংসের দ‌্যোতনাকে সঙ্গে নিয়েই, বারবার ফিরে এসেছে সফোক্লিস, এস্‌কিলাসের ট্র্যাজেডিতে, বিবর্তিত হয়েছে দস্তয়েভস্কির ট্র্যাজিক দর্শনে ও উপন‌্যাসে। এই অমোঘ কণ্ঠস্বর ও উচ্চারণ কোন সাধনায় পেয়েছে প্রসেনজিৎ! মন্ত্রের মতো এই উচ্চারণ থামিয়ে দেয় সময়, তৈরি করে অবিস্মরণীয় নৈঃশব্দ, চুরমার করে গার্গীর নিমীলন। থেমে যায় তার গান। এরপর গার্গীর ভয়? না রাগ? না কি, ভয়-রাগের ভিতর থেকে উঠে আসা কুণ্ঠিত অনুরাগ? গার্গী কোনও কথা বলে না।

Gargi

সংলাপহীন গার্গীর অতুল অভিনয়। পরিচালক অতনু জানেন গার্গীর অভিনয় এবং তার আকর্ষণ ও তনু সৌন্দর্যের সব থেকে জোরালো উপাদান তার মেধা। (তার অভিনীত মেধা চরিত্রের নামটি তা-ই সার্থক)। ক্রমিক ক্লোজ আপে তা-ই গার্গীর কপাল, ঠোঁট, এবং আত্মধী আঁখিপাত। যাঁরা বুঝলেন, তাঁরা বুঝলেন, নিবিড় কবিতার মতো এই মুহূর্তটি উত্তীর্ণ হল দ্রৌপদীশাড়ির অনন্ত প্রসারে। গার্গীর (Gargi Roy Chowdhury) ওই আশ্চর্য আঁখিপাত আমাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে ভিতর পর্যন্ত। তখনও কিন্তু জানি না আমি, ‘শেষ পাতা’-র শেষ দৃশ‌্যে অতনু আবার ফিরিয়ে আনবেন গার্গীর দৃষ্টিপাতের এই প্রসারী কুহক। বাংলায় এখন অ‌্যাকশন ছবির দ্রুতি ও প্লাবন। কেন হারিয়ে যাচ্ছে প্রসারিত, শান্ত, গভীর বোধের এই দীপন? আরও একটি দীপিত মুহূর্ত আঁকড়ে আছে আমার স্মৃতি। গার্গী উন্মার্গগামী, এমনকী বেশ‌্যাসক্ত বাল্মীকি-প্রসেনজিতের দিকে তাকিয়ে গাইছে রবীন্দ্রনাথ: ‘ব‌্যথার টানে তোমায় আনবে দ্বারে।’

[আরও পড়ুন: ‘প্রেমিকারা জীবন শেষ করতেই আসে’, প্রাক্তনদের একহাত নিলেন সলমন খান]

অকল্পনীয় প্রসেনজিৎ (Prosenjit Chatterjee)। তার বুকে অতিমানবের তেষ্টা এবং সাহস। বলিউডের সুপার হিরোরা যখন গ্ল‌্যামার বাঁচাতে করুণ মরিয়া, টলিউডের প্রসেনজিৎ কী দারুণ দুঃসাহসে আরও একবার ধ্বংস করল তার রোম‌্যান্টিক নির্মাণ, বেরিয়ে এল সমস্ত মুখোশ ও আড়াল থেকে বিদগ্ধ বিনির্মাণে, দেখাল সেই উত্তর-আধুনিক লিক্যুইডিটি তার অভিনয়ে ও প্রকাশ ভঙ্গিতে, যে তারল‌্যের দর্শন প্রসঙ্গে লিখেছেন উমবের্তো একো। এ-ছবির প্রসেনজিৎ এক পালছেঁড়া, হালভাঙা তরী। গেঞ্জি পরলে কণ্ঠার হাড় দেখা যায়। চুল উসকো-খুসকো। কাঁচা-পাকা দাঁড়ির রুক্ষ্মতা তার গালে। ব‌্যবহারে আপাত বন‌্যতা। কিন্তু বনের মধ‌্যেই আছে লাবণ‌্যের ঝলক।

Sesh Pata

হারিয়ে গেছে লেখা। কিন্তু হারায়নি তার তেষ্টা। প্রতিভা ছেড়ে গেছে। শুকিয়ে গেছে শিকড়। কিন্তু তার কণ্ঠ চায় অবিরত কোহল। প্রসেনজিৎ এক নিরন্তর ‘কোহলিক’। অসামান‌্য এক মাতাল দৃশ‌্যে প্রসেনজিৎ বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। কারণ, ঝড় জলের মধ‌্যেও তাকে কিনতে হবে সিগারেট। গার্গী আর্তিময়। নিষেধ করে বাইরে যেতে। কারও কথা শোনা স্বভাবে নেই ‘শেষ পাতা’র প্রসেনজিতের। সে এক সদা-তাড়িত চরিত্র। গার্গী একা অপেক্ষা করে প্রসেনজিতের নির্জন, নির্মম গুহাঘরে। একদিন যেখানে ছিল জীবনের উত্তাপ ও সমারোহ।

গার্গী অসামান‌্য অভিনয়ের বিন্দু-বিন্দু অবদানে তৈরি করে এক অনন‌্য অপেক্ষার দৃশ‌্য– কোনও কথা নেই। শুধু অপেক্ষা ও উদ্বেগ। প্রসেনজিৎ ফেরে। সবে হাঁটতে শেখা শিশুর টলায়মানতা ও সারল‌্যে। পাঞ্জাবি, পাজামা তোলপাড় বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। গা এলিয়ে দেয় সে চেয়ারে। গার্গী জানে এভাবে বসে থাকলে মানুষটা ঠান্ডা লেগে অসুস্থ হয়ে পড়বে। অনিবার্য কুণ্ঠা অবশ করে দেয় গার্গীকে। আবার বোধের দীপ্তিতে উজ্জ্বল গার্গী সমস্ত পোশাক উপড়ে নেয় প্রসেনজিতের শরীর থেকে। কী করুণ-সুন্দর-মায়াবী এই দৃশ‌্য। উষ্ণ টাটকা পোশাক পরিয়ে দেয় গার্গী। বাল্মীকি ও মেধার এই মিলনদৃশ‌্যে পরিচালক অতনু নিয়ে এসেছেন তনু-অন্বয়ের গভীর-প্রসারী ব‌্যঞ্জনা। নারী-পুরুষের সম্পর্ক এই দৃশ‌্যে সত‌্যিই ছুঁয়েছে মহত্তম মুহূর্ত। সেক্সুয়ালিটি পৌঁছেছে সংশয়হীন সংহিতায়।

এ-ছবির আরও এক সমস‌্যা ও বাসনা তাড়িত জুটি শৌনক ও দীপা। শৌনকের চরিত্রে বিক্রম চট্টোপাধ‌্যায় (Vikram Chatterjee)। দীপার চরিত্রে রায়তি ভট্টাচার্য। অতনু শৌনককে গড়েছেন ধ্রুপদী-আইরনির অনুষঙ্গে। রায়তির দীপা বিভিন্ন সস্তার হোটেলে বিছানায় যায় বিক্রম-শৌনকের সঙ্গে। বিক্রম করে ঋণ শোধের টাকা আদায়ের কাজ। আদায় করা যার কাজ, সে পৌঁছয় আদায়ের কাজের সার্বিক রুক্ষ্মতায়। সে আদায় করে দীপার প্রেম ও শরীর। এবং সে প্রসেনজিতের কাছে আসে লেখা আদায়ের নির্মন, নির্মম তাগাদায়। কারণ এই লেখার জন‌্য প্রসেনজিৎ নিয়েছে চল্লিশ হাজার টাকা অ‌্যাডভান্স। কিন্তু মদে উড়িয়ে দিচ্ছে টাকা। টাকা দিচ্ছে রক্ষিতাকে। কিন্তু লেখার নাম নেই। অথচ সে যদি লেখে তার নিজের স্ত্রীর কেচ্ছা নিয়ে, যে-সেক্সকেচ্ছার শেষে তার স্ত্রীকে কে বা কারা ময়দানে ফেলে দিয়ে যাচ্ছে হত‌্যা করে, সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায়। এই কেচ্ছা লিখলে লেখক হতেই পারে সম্পূর্ণ ঋণ মুক্ত। কিন্তু ঋণ শোধের জন‌্য সম্ভব এই আপস? অস্তিত্বের এই জটিল সংকটে লেখক বা শিল্পী বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পলাতক দেবদাস-সরণি, বা রূঢ় হেমিংওয়ে পথ। এই সংশয় ও সমস‌্যা জর্জর মানুষটির জীবনে গার্গী আসে। কী করে এবং কেন? সেই বার্তার গহনটুকু জানতে দেখতেই হবে ‘শেষ পাতা’ (Shesh Pata)।

ছবি – শেষ পাতা
অভিনয়ে – প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, গার্গী রায়চৌধুরী, বিক্রম চট্টোপাধ্যায়, রায়তি ভট্টাচার্য
পরিচালনায় – অতনু ঘোষ

[আরও পড়ুন: ‘প্লিজ বাবা আবার জন্ম নিও না…’, কাতর অনুরোধ সতীশ কৌশিকের ১০ বছরের মেয়ের]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement