ইন্দ্রনীল শুক্লা: শরৎ চাটুজ্জের লেখা ‘অভাগীর স্বর্গ’ পড়েননি এমন শিক্ষিত বাঙালি বিরল। শখ করে যাঁরা গল্প পড়েন না, তাঁরাও এমনকী টেক্সট বইতে এই গল্প পড়েছেন। স্কুলে মাস্টারমশাই ক্লাশ নিয়েছেন এবং পরীক্ষা দিতে হয়েছে। এখন কথা হচ্ছে, এমন অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় কাহিনি নিয়ে সিনেমা তৈরি হলে তা নিয়ে আলাদা একটা এক্সপেকটেশন তৈরি হয় তো বটেই। আর শরৎবাবুর কারণেই একটা অডিয়েন্স পুল-ও তৈরি হয়ে যায়। সেটাই ঘটেছে ‘ও অভাগী’-র ক্ষেত্রে। পাশাপাশি, ছবির পরিচালকও অবশ্য অন্য একটা সমস্যার সম্মুখীন হতে বাধ্য। তা হল তুলনা। মূল গল্পে অমুক ছিল, এখানে কেন তমুক রাখা হল ইত্যাদি আলোচনা হবেই হবে। এই গল্পটা ছাপার পাতার পাঁচ পাতার মতো। তা থেকে প্রায় দু ঘণ্টার একটা ছবি কেমন করে হল? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যেতে পারে ছবিটাতে বরং দুটো ভাগে ভাগ করে নেওয়া ভাল। ছবির প্রথম অংশের প্রায় ৫০ মিনিটের কাহিনি তৈরি করে নেওয়া হয়েছে। আর পরবর্তী অংশটা মোটামুটিভাবে শরৎবাবুর টেক্সটই ফলো করা হয়েছে। শুনেই বোঝা যাচ্ছে প্রথম অংশটায় একটা চ্যালেঞ্জ রয়েই গিয়েছে। অভাগীর জীবনের একটা পূর্বকথা গড়া হয়েছে, তবে তা টেক্সটের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই। যেমন, অভাগীর বিয়ে কেমন ভাবে হয়েছিল তা আমরা বিশদে জানি না। এখানে সেই অংশ আমরা দেখি। স্বামী অভাগীকে ত্যাগ করার সাক্ষীও হই। আবার, অভাগীর স্বামী রসিক বাঘ সম্পর্কে শরৎবাবু এককথায় সেরে দিয়েছিলেন ‘বাঘের অন্য বাঘিনী’ আছে, এই কথা বলে। এখানে সেই ‘বাঘিনী’কে দেখানো হয়েছে। রসিক এখানে নানা গ্রামীণ অনুষ্ঠানে গান গেয়ে বেড়ানো এক শিল্পী। এই রকমভাবে ছবির সম্প্রসারণ ঘটানো হয়েছে।
ছবিতে কয়েকটা বিষয় যুক্ত করা হয়েছে, যা সিনেম্যাটিকভাবে আকর্ষণীয়। যেমন, কিশোরী অবস্থায় এক যাত্রাপালায় যমরাজরূপী অভিনেতাকে দেখার পর তাকে হ্যালুসিনেট করতে থাকে অভাগী। এমনকী বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে সঙ্গমের সময়েও! এভাবেই কখন যেন সে মৃত্যুকেই কামনা করতে থাকে। শরৎবাবুর কাহিনির ভিত্তিতে ছবি তৈরি করে তাতে এমন মুহূর্ত তৈরি করার জন্যই অবশ্যই প্রশংসা প্রাপ্য পরিচালক অনির্বাণ চক্রবর্তীর। দেখা যাচ্ছে, ঠাকুরদাস মুখুয্যের (সুব্রত দত্ত) মতো জমিদারদের সঙ্গে ওয়ান শটার পিস্তলধারী চ্যালা কেষ্ট (কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়) জুটে গিয়েছে। ক্ষমতা মুঠোয় রাখতে এর সবকিছু করতে প্রস্তুত। আবার, ছবির নানা অংশে অনৈতিক সেক্সের একটা চোরাস্রোতও বয়ে গিয়েছে। বামুন গিন্নি (দেবযানী চট্টোপাধ্যায়) মারা যাওয়ার পর চোখের জল শুকোনোর আগেই শয্যাসঙ্গী খুঁজতে বেরোন জমিদার। আবার অভাগীর মতো স্বামী পরিত্যক্ত মহিলার দিকেও লোলুপ চোখ বহু গ্রামবাসীর। একটা কথা অবশ্য এই প্রসঙ্গে বলা দরকার, সেক্সের আতিশয্যের কারণেই ছবিটা আর পারিবারিক গল্প থাকেনি, কিংবা কিশোর সন্তান কাঙালিকে নিয়ে সিঙ্গল মাদার অভাগীর লড়াই থাকেনি। আবার, জমিদার গিন্নির চিতা থেকে উঠতে থাকা ধোঁয়াকে অভাগীর কল্পনার উপর ছেড়ে না দিয়ে অ্যানিমেশনে মেঘের রথ তৈরিটাও যেন অতিরিক্ত মনে হয়েছে। আবার মৃত স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রসিকের কথাগুলোও মেলোড্রামাটিক লেগেছে। চোখে জল এসে যাওয়াই বোধহয় যথেষ্ট ছিল, যেমনটা শরৎবাবু লিখেছিলেন। (ওই যে গোড়ায় বলেছিলাম, তুলনা এসে পড়তে বাধ্য!)
কাঙালির চরিত্রে সৌরভ হালদারকে ভাল লেগেছে। অভাগীর ভূমিকায় বাংলাদেশের অভিনেত্রী রাফিয়াদ রশিদ মিথিলা চমৎকার অভিনয় করেছেন। তবে এও সত্যি যে তাঁর মধ্যে এমন একটা ন্যাচারাল গ্ল্যামার রয়েছে, যে চরম দারিদ্রক্লিষ্টা এক মহিলার ভূমিকায় একেক সময়ে তাঁর ভাল অভিনয়কে ঢাকা দিয়েছে লাবণ্যময়ী রূপ! সংগীত পরিচালক মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় খুব সুন্দর সুরারোপ করেছেন। ঢেঁকিতে ধান ভাঙার সময়ে একটা গান খুব বুদ্ধি করে অ্যারেঞ্জমেন্ট করা হয়েছে, যা দৃশ্যের সঙ্গে মিশে গিয়েছে একেবারে। মলয় মণ্ডলের ক্যামেরা ভারি সুন্দর করে ধরেছে গ্রামের দৃশ্যকে। কিছু কিছু ফ্রেম আলাদা করে ভাল লেগেছে।
ছবির শেষটা কিন্তু চমকপূর্ণ। ছবিতে কাঙালি কিন্তু পাটকাঠি থেকে উঠতে থাকা ধোঁয়ার দিকেই স্রেফ চেয়ে থাকেনি মূল গল্পের মতো। তার রাগ অন্য মাত্রা নিয়েছে। বুকের জমা পাথর কখন যেন ঠুকতে ঠুকতে আগুন লেগে গিয়েছে বনে!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.