বিশাখা পাল: সত্য ঘটনাকে কল্পনার পাঁচফোড়ন দিয়ে বিনোদনের মোড়কে কীভাবে পরিবেশন করতে হয়, তা দেখিয়ে দিল টিম ‘মিশন মঙ্গল’। পর্দায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মঙ্গলযাত্রা একবারের জন্যও পলক ফেলতে দেয় না দর্শককে। এর জন্য কৃতীত্বের পুরোটা না হলেও সিংহভাগেরই দাবিদার চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক জগন শক্তির।
‘হোম সায়েন্স’ আর ‘স্পেস সায়েন্স’। দুটির পিছনে পদবীর মতো ‘সায়েন্স’ কথাটি জুড়ে থাকলেও এই দুইয়ের বিজ্ঞান আদ্যোপান্ত আলাদা। কিন্তু এই ‘হোম সায়েন্স’ দিয়ে যে ‘স্পেস সায়েন্সে’ র একের পর এক বাধা অতিক্রম করা যায়, তা দেখিয়েছেন বিদ্যা বালান ও অক্ষয় কুমার। ইসরোর অন্দরমহলে এমন ঘটেছে কিনা, তার কোনও গল্প শোনা নেই। কিন্তু সত্যিই যদি হয়ে থাকে, তবে ইসরোর ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ‘হোম সায়েন্স’টা বিশেষ কিছু নয়। যদি লুচি ভাজার সময় তেল গরম হয়ে যায়, সেই গরম হওয়া তেলেই বেশ কয়েকখানা লুচি ভেজে ফেলা যায়। গ্যাস জ্বালানোর দরকার হয় না। জ্বালানি বাঁচে। এই সহজ থিয়োরির উপর ভিত্তি করেই মঙ্গলজয় করে ফেলেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। মিশন MOM-এর (ছবিতে মিশনের নাম MOM কেন, তাও দেখানো হয়েছে) মিশন ডিরেক্টরকে তার সিনিয়রদের রাজি করানোর জন্য অফিসে লুচি ভেজে দেখাতে হয়েছিল কিনা জানা নেই, কিন্তু এই থিওরির উপর ভিত্তি করে যে প্রথম চেষ্টাতেই ভারত মঙ্গলজয় করে ফেলেছে, তা আজ গোটা বিশ্বকে অবাক করে।
চন্দ্রযান সফল না হওয়ায় প্রজেক্টে নেতৃত্ব দেওয়া দুই বিজ্ঞানীকে সরিয়ে দেওয়া হয় মঙ্গল অভিযানে। আমেরিকা ও রাশিয়ার মতো দুই তাবড় দেশ যেখানে একবারে মঙ্গল বিজয় করতে পারেনি, সেখানে ভারত তো নগণ্য শিশু। অতএব ধরেই নেওয়া হয়, মঙ্গল অভিযান শুরুর আগেই ব্যর্থ। কিন্তু মেয়েরা বোধহয় অসম্ভবের মধ্যেও সম্ভবকে খুঁজে পায়। তাই ‘মিশন মঙ্গল’ শেষ পর্যন্ত সফল হয়। স্বপ্ন অনেকেই দেখে। কিন্তু তাকে সফলতা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার আত্মবিশ্বাস, সাহস আর স্পর্ধা খুব কম মানুষের মধ্যে থাকে। ইসরোর বিজ্ঞানী তারা শিণ্ডে সেই গুটিকতক মানুষের একজন। বাজেট নেই, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একরকম যুদ্ধ করেই টাকাপয়সা জোগাড় করেন প্রজেক্ট ডিরেক্টর রাকেশ ধাওয়ান। ‘চন্দ্রযান ২’ পিছিয়ে যাওয়ায় ‘মঙ্গলযানে’র ভাগ্য খুলে যায়। শুরু হয় ‘মিশন মঙ্গল’- অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা।
ইসরোর বিজ্ঞানীদের সেদিনের সেই স্পর্ধার ফলশ্রুতি কী, সে সম্পর্কে আজ গোটা বিশ্ব অবগত। কিন্তু তার যাত্রাপথ যে কুসুমাবৃত ছিল না ‘মিশন মঙ্গল’ সেকথা স্পষ্টভাবে বলে দেয়। আর এখানেই সাধুবাদ প্রাপ্য পরিচালক মহাশয়ের। তারা শিণ্ডের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বিদ্যা বালান। তাঁকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। অভিনয়ে সবসময় তিনি ফুল মার্কস পেয়ে থাকেন। বরং অক্ষয় কুমারের তাঁর তুলনায় ম্লান। যদিও অভিনেতার এখানে তেমন কিছু করার ছিল না। এঁদের দু’জনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করে গিয়েছেন কৃতী কুলহারি, তাপসী পান্নু, সোনাক্ষী সিনহা, নিত্যা মেনন ও শরমন যোশী। এই শেষ জনের অবস্থাও তথৈবচ। আসলে গোটা ছবিটাই নারীশক্তির জয়জয়কার। সবাইকে ঢেকে দিয়েছেন একা বিদ্যা।
তবে শুধু সত্যি ঘটনাকে সেলুলয়েডে ফুটিয়ে তুললেই তো আর সিনেমা হয় না। চাই কল্পনার মিশেল। এখানে সেটিও উপস্থিত। যদিও ঘটনা ও পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচালক তাঁর কল্পনাকে যেভাবে মিশিয়েছেন, তাতে দুটোকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। ছবিতে একেবারেই ব্রাত্য পূরব কোহলি, সঞ্জয় কাপুর ও মহম্মদ জিসান আইয়ুব। তাঁদের চরিত্রটি নিতান্তই ক্ষুদ্র। কিন্তু অবশ্যম্ভাবী। চিত্রনাট্যের দৌলতে সোনাক্ষী ও শরমন জুটির মধ্যে প্রেমের হালকা চোরাস্রোত দর্শককে খুব সিরিয়াস হওয়া থেকে বিরাম দেয়।
আসলে গোটা ‘মিশন মঙ্গল’ ছবিটাই অদ্বিতীয়। মাঝে একটা বিজ্ঞানীদের নাচ ছাড়া তেমন ভুরু কোঁচকানোর মতো কিছু নেই। কিন্তু সেটিও চিত্রনাট্য, পরিচালনা আর অভিনয়ের গুণে চোখে পড়বে না। আর এটুকু না থাকলে তো আর পুরোদস্তুর ফিচার ফ্লিল্ম হয় না। তবে টানটান উত্তেজনা ছবির প্রথমার্ধেও যেমন বর্তমান, শেষার্ধেও। বরং মাঝে মধ্যে পর্দার বিজ্ঞানীদের সঙ্গে চাপা টেনশন সঞ্চারিত হবে আপনার মধ্যেও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.