বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: পরিচালক শংকর রমনের প্রথম ছবি ‘গুরগাঁও’ দেখলে বোঝা যায় পিতৃতন্ত্র এবং হিংসাকে তিনি আলাদা করে দেখেন না। উত্তর ভারতের একটি গ্যাংস্টার পরিবারের অন্দরমহলের পিতৃতন্ত্রের নানান স্তরের ক্লোজ আপ আতস কাচের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছিলেন ‘গুরগাঁও’ ছবিতে। সেই ছবিতে ভায়োলেন্সের প্রভাব পরোক্ষ হলেও তার শ্বাসরোধকারী উপস্থিতি টের পাওয়া গিয়েছিল সর্বক্ষণ। পরিচালকের দ্বিতীয় ছবি ‘লাভ হোস্টেল’ (Love Hostel) সেখান থেকে আরও একধাপ এগিয়ে যায়। এখানে মানুষ মরে মশা-মাছির মতো। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই গায়ে লাগে রক্তের ছিটে। আর এই ছবিতেও রয়েছে পিতৃতন্ত্রের অপ্রতিরোধ্য দমননীতি। এখানেও প্রেক্ষাপট সেই উত্তর ভারত। পরিচালক কেবল তাঁর ক্যামেরাকে জুম আউট করেছেন।
হরিয়ানার উচ্চ বর্ণের হিন্দু পরিবারের মেয়ে জ্যোতি দিলাবর (সানিয়া মালহোত্রা) তার প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে বাড়ির অমতে বিয়ে করে। এখানে প্রেমিক ভিন্নধর্মী এবং সংখ্যালঘু। নাম আহমেদ সৌকিন (বিক্রান্ত মাসে)। সবাই তাকে আশু বলেই চেনে। জ্যোতি এবং আহমদের মতো প্রেমিক যুগলদের এখানে একটাই শাস্তি। মৃত্যুদণ্ড। হিন্দু পরিবার এমন সম্পর্ককে ঘেন্না করে।
ছবির শুরুতেই আমরা দেখি ‘দাগর’ (ববি দেওল) নামের এক ব্যক্তি এমনই এক প্রেমিকযুগলকে নৃশংসভাবে খুন করে। এই ‘দাগর’ গোটা এলাকায় এই কাজের জন্যই কুখ্যাত। সাইকোপ্যাথ ‘দাগর’ অবশ্য নিজেকে সমাজসেবী বলে বিশ্বাস করে। হিন্দু ধর্মের রক্ষাকর্তা মনে করে নিজেকে। যারা পালিয়ে গিয়ে কোর্টে গিয়ে বিয়ে করে, কোর্টের নির্দেশেই তাদের ঠাঁই হয় সেফ হোমে। রাষ্ট্রের তৈরি করা এমন নিশ্ছিদ্র কারাগার যেখানে ঢোকা যায়, কিন্তু বেরনো যায় না। এই ‘সেফ হোম’ পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়।
জ্যোতি এবং আহমেদ সেই সেফ হোমে যে সেফ নয়, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। একদিকে জ্যোতির ঠাকুমার পাঠানো ভাড়াটে গুণ্ডা ‘দাগর’ (যাকে দেখলে ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড ম্যান’-এর ‘হাভিয়ের বার্ডেম’-এর কথা মনে পড়বে), অন্যদিকে সেফ হোমের সরকারি পুলিশ অফিসারের ব্ল্যাকমেল। ছবিতে একটা বিষয় খেয়াল করার মতো। লিঙ্গবৈষ্যম নিয়ে তথাকথিত চিন্তাধারাকে পরিচালক একটু উল্টে-পাল্টে দিয়েছেন। আহমেদকে আমরা দেখি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে, একটু ভয়ে-ভয়ে, সমঝে চলতে। আর জ্যোতি এখানে বেপরোয়া, মাথা উঁচু করে সোচ্চার হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
কারণ একটাই, সংখ্যালঘু ধর্মের অন্তর্গত আহমেদ জানে এই দেশে মাথা নিচু করেই চলতে হয়। কারণ মাংসের দোকানে কর্মরত তার বাবাকে টেররিস্ট বলে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। না চাইতেও আহমেদকে ‘ডেলিভারি’-র কাজ করতে হয়। সে মাথা তুলবে কোন সাহসে। জ্যোতি আবার চটপটে, সাহসী ও মুখরা। কারণ, তার জন্ম উচ্চবর্ণ হিন্দু পরিবারে। আবার এই মেয়েই ঘরের বাইরে মাথা উঁচু করে লড়াই করার সাহস রাখলেও বাড়ির ভিতরে তার চেয়ে এগার-বারো বছরের ছোট ভাইয়ের কাছে মার খায়। গোটা ছবি জুড়ে রয়েছে এই ডাইকোটমি।
এই সময়ে দাঁড়িয়ে নিঃসন্দেহে সাহসী এবং রাজনৈতিক ছবি ‘লাভ হোস্টেল’। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে সিনেম্যাটিক লাইসেন্স ব্যবহার করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করেছেন পরিচালক। ‘দাগর’ যতই কুখ্যাত কনট্রাক্ট কিলার হোক না কেন, এইভাবে মুড়ি মুড়কির মতো মানুষ মেরে কী করে দিব্যি ঘুরে বেড়ায় সেটা একটা বিশাল প্রশ্ন। আর যেভাবে মশা-মাছি মরার মতো মানুষ মরে তা এতটাই গা-সওয়া হয়ে যায় যে আলাদা করে কোনও ছাপ তৈরি করে না।
‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড ম্যান’ ছবিতে ‘অ্যান্তন চিগুড়’ (হাভিয়ের বার্ডেম) সিনে এলেই একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যেত। এখানে সেই ইমপ্যাক্ট তৈরি হয় না। পুলিশের খুব কিছুই করার নেই। একটা সংলাপেই সেটা স্পষ্ট। ‘বর্দি উতারকে সরকার বদলনে কা ইন্তেজার করু ক্যা?’
সানিয়া মালহোত্রা (Sanya Malhotra) বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া। বিক্রান্ত মাসে (Vikrant Massey) সব ধরনের চরিত্রে নিজেকে মোল্ড করে নিতে পারেন। ববি দেওলের (Bobby Deol) চরিত্রায়ন যতটুকু সেই অনুযায়ী তাকে ভালই লাগে। ‘লাভ হোস্টেল’ ছবিটি জরুরি হলেও চিত্রনাট্য দুর্বল। এই ছবি সেই উচ্চতায় পৌঁছয়নি এই কারণেই।
সিনেমা – লাভ হোস্টেল
পরিচালক – শংকর রমন
অভিনয়ে – বিক্রান্ত মাসে, ববি দেওল, সানিয়া মালহোত্রা, রাজ অর্জুন, অক্ষয় ওবেরয়
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.