ভাস্কর লেট: নোবেল পুরস্কারকে ‘আলুর বস্তা’ বলে ‘রিজেক্ট’ করেছিলেন জাঁ পল সার্ত্রে, সোজা কথা! তা, ১৯৭৫ সালে এই দুঁদে পণ্ডিতের একটি ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন তাঁর লম্বা সময়ের বান্ধবী ও লিভ-ইন পার্টনার সিমন দ্য বোভোয়া।
প্রথমেই সিমন জানতে চান– আচ্ছা সার্ত্রে, তুমি তো শোষিত ও বঞ্চিত শ্রেণি নিয়ে অনেক কিছু বলেছ, লিখেছ। কখনও শ্রমিকদের নিয়ে। কখনও কালো মানুষদের নিয়ে। কখনও সংখ্যালঘু ইহুদিদের নিয়ে। কিন্তু মেয়েদের নিপীড়ন নিয়ে তো তেমন সরব হতে শুনিনি তোমাকে। কেন গো? সার্ত্রে থতমত খেয়েছিলেন কি না জানি না। তবে উত্তরে যা বলেছিলেন, খুব কনফিডেন্ট লাগেনি।
সার্ত্রে-র জবাব ছিল, বর্ষীয়সী মহিলা মহলে ছোটবেলা কেটেছে আমার। পরে, খুদে বান্ধবীও হয়ে যায় অনেক। সেজন্য আমার ভেতরে একটুকরো সহজাত মেয়েলি সত্তা ঢুকে আছে। বোঝো! সিমন দেরি না-করে অবশ্যম্ভাবী পরের প্রশ্নটি করে ফেলেন– হতে পারে নারী-পরিবৃত ছোটবেলা কেটেছে তোমার। তা’ বলে তুমি মেয়েদের উপর হয়ে চলা নির্যাতনের ইতিহাস অবহেলা করতে পারো কি? সার্ত্রে এর উত্তর দেন। তবে এবারও তাঁকে নিষ্প্রভ ও নড়বড়ে শোনায়।
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের (Kaushik Ganguly) ‘লক্ষ্মী ছেলে’ (Lokkhi Chele) সিনেমা নিয়ে বলতে গিয়ে এই ঐতিহাসিক সংলাপ মনে পড়ল। কেন? না, লিঙ্গ রাজনীতির ময়াল সাপটিকে কী করে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, সে-বিষয়ে অজ্ঞানতা তখনও ছিল, এখনও আছে। মেয়েদের কী করে মাপতে হবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা তখনও ছিল, এখনও আছে। মেয়ে-অধ্যুষিত পরিমণ্ডলে বড় হয়েছেন– এই ফ্যাকাশে যুক্তি দেখিয়ে সার্ত্রের মতো বাঘা তাত্ত্বিক যদি শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস থেকে মেয়েদের উপস্থিতিকে হেলাফেলা করতে পারেন, তাহলে সেই অন্ত্যজ ও অনালোকিত ভারতীয় পুরুষতন্ত্রের কী আর দোষ দেব– যারা চারটি হাতের অধিকারী মেয়েকে ‘দেবী’ বানায়, এদিকে দু’টি হাতওয়ালা সুস্থ ও স্বাভাবিক মেয়েদের বেধড়ক মারে? আসলে, যথেষ্ট এডুকেটেড নয় বলে এই বীরপুঙ্গবরা বুঝতে পারে না যে, চার হাতের মেয়ে বাস্তবে হয় না। যদি এমন মেয়ে ভূমিষ্ঠ হয়, তাহলে চিকিৎসা বিজ্ঞান ‘অ-স্বাভাবিক’ শিশু বলেই তাকে গণ্য করবে। ‘লক্ষ্মী ছেলে’ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে আবারও বলে, জলজ্যান্ত একটি মেয়েকে ‘দেবী’ বানাতে চাওয়াও এক ধরনের ‘অপ্রেশন’, উৎপীড়ন।
সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ মনশ্চক্ষে ভেসে উঠতে পারে এটুকু শুনে। তাহলে ‘লক্ষ্মী ছেলে’ কোথায় পৃথক? সংক্ষিপ্ত উত্তর: সাহসে ও সংগ্রামে। দেবীত্বের ঐশী ডালপালা কেটে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় একটি শারীরিক ত্রুটিসম্পন্ন কন্যাকে মানব-মূল্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই নাছোড় লড়াইয়ে তাঁর সহায় তিনজন জুনিয়র ডাক্তার। যারা ধর্মাধর্মের চেয়ে বেশি বোঝে মানুষের মঙ্গলাচরণ। কার চিকিৎসা করছে এটার চেয়ে গুরুত্ব দেয়, যার চিকিৎসা করছে তাকে প্রাণে বাঁচাতে পারছে কি না। কোভিডের স্মৃতি চাবুক মারে যেন! করোনার সময়েও তো ডাক্তারাই ছিলেন সবচেয়ে প্রণম্য।
বর্ণাশ্রমে দণ্ডিত হিন্দু সমাজের অনমনীয় স্ট্রাকচার এই সিনেমার গল্পকে পিছনে টানতে চায়। দেখায়, স্বার্থের খাতিরে উচ্চকোটির হিঁদুয়ানি সব পারে। এমনকী, ‘অস্পৃশ্য’ বলে দেগে দেওয়া জনগোষ্ঠীকে শুদ্ধিকরণের মারফতে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে পারে মূল সমাজে। এই ভণ্ডামি দেখে হাসি পায়। এই প্রসঙ্গে মনে পড়তে বাধ্য পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ বইয়ে দীপেশ চক্রবর্তীর আশ্চর্য প্রবন্ধটির কথা। মানুষের শরীর যে মুখ্যত তার, এই ভাবনা ‘চরক সংহিতা’-য় মান্যতা পায়নি। দীপেশবাবু বরং ধরিয়ে দিয়েছেন যে, সেখানে ব্যক্তিমানুষের শরীরকে দেখা হয়েছে জাত ও কুল সাপেক্ষে। ভাবা যায়! ফলে, একটি নিম্নবর্গের মেয়ের শরীরী খুঁত যে অবহেলিত হবে আর উচ্চবর্গের ষড়যন্ত্রে চালিত হয়ে টাকা রোজগারের মেশিনে পরিণত হবে, এতে আর নতুন কী।
‘লক্ষ্মী মেয়ে’ মায়াকাজল পরানো রূপক শব্দ। নিখুঁত নারী নির্মাণের ফাঁদ নয় কি? পরিচালক হিসেবে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব– ‘লক্ষ্মী ছেলে’ কথাটিকে ‘মেটাফর’ নয়, বরং অন্তর্ঘাতী বারুদের মতো ব্যবহার করেছেন তিনি। জুনিয়র ডাক্তার ‘অমরনাথ’ ওরফে ‘আমির হোসেন’ যে এই অচলায়তনিক সমাজের প্রেক্ষিতে মানববোমার মতোই বিস্ফোরক ও বিপজ্জনক, তা বুঝতে ছবিটি দেখতে হয়।
ছবিটি দেখতে হয় আরও একটি কারণে। বহু দিন পরে প্রাদেশিক বঙ্গভাষায় নির্মিত একটি সিনেমা বিষয়, প্রকরণ আর অভিনয়ের কম্বো নিয়ে ঝলমলে অভ্যুত্থানের ইঙ্গিত দিতে পারল। এই চমৎপ্রদ এক্সপেরিমেন্টের রণ-পা চেপে যদি বাংলার সিনে-বাণিজ্যে লক্ষ্মীর বসত স্থায়িত্ব পায়, আমরা উলু দেব, শাঁখও বাজাব।
প্রযোজক শিবপ্রসাদ (Shiboprosad Mukhopadhyay)-নন্দিতা (Nandita Roy) জুটিকে ধন্যবাদ। চর্বিতচর্বণ কনসেপ্টের বাইরে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশ দেখানোর জন্য। সব চরিত্র, চিত্রনাট্যের সঙ্গে, সামঞ্জস্যপূর্ণ। চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায় (Churni Ganguly), প্রদীপ ভট্টাচার্য (Pradeep Bhattacharya), অম্বরীশ ভট্টাচার্য (Ambarish Bhattacharya), বাবুল সুপ্রিয় (Babul Supriyo), ইন্দ্রাশিস (Indrasish Roy) প্রত্যেকেই মেদবর্জিত অভিনয় করেছেন। তবে সবচেয়ে বড় পাওনা একমুঠো মনোরম শরৎ-রোদের মতো নবীন প্রজন্মের তিনজন জুনিয়র ডাক্তারের অভিনয়। পূরব, ঋত্বিকা, সর্বোপরি উজান (Ujaan Ganguly) এই সিনেমার সম্পদ। অভিনয়বিদ্যায় এঁরা প্রত্যেকে আগামীতে দশভুজ হয়ে উঠুক– এটুকু প্রত্যাশা করতেই পারি। প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর সিনেমায় মেঘ ও রৌদ্রের মতো খেলা করে, রূপক ও বাস্তবের টানাপোড়েনের মাঝে আমাদের নবজাগরণ ঘটায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.