শম্পালি মৌলিক: দেশ-বিদেশের অনেক ফিল্মোৎসবে ‘লরেল’ অর্জন করে অবশেষে মুক্তি পেয়েছে ‘কালকক্ষ’ (Kalkokkho Review)। নবীন পরিচালক জুটি শর্মিষ্ঠা মাইতি ও রাজদীপ পালের এই ছবিটি ঘিরে শুরু থেকেই আগ্রহ ছিল, যার প্রথম কারণ, ‘কালকক্ষ’-র মাধ্যমেই প্রায় ৪৩ বছর পরে ফিল্ম প্রযোজনায় ফিরল ১১৬ বছরের প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী ‘অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশন’। যে প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে ‘পথের পাঁচালী’, ‘জলসাঘর’, ‘অপরাজিত’-র মতো ছবির নাম জড়িয়ে তাদের সাম্প্রতিকতম কাজ কেমন হল, দেখার ইচ্ছে ছিল। ইতিমধ্যেই ছবিটি আন্তর্জাতিক স্তরে সাড়া জাগিয়েছে এবং বিবিধ উৎসবে প্রশংসিত হয়েছে। সেই ছবি এতদিনে এল দর্শকের সামনে। অতিমারী ছবি মুক্তিতে যেমন বিঘ্ন ঘটিয়েছে, এই ছবির বিষয়ের সঙ্গেও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে অতিমারী-ক্লান্ত সময় এবং একঘরে-বিচ্ছিন্ন মানুষের জীবন। নামেই আন্দাজ পাওয়া যায়, ছবিটি খুবই ভিন্ন ধরনের। দেখতে গিয়ে বুঝলাম বেশ এক্সপিরিমেন্টাল ফিল্ম, বিষয়-ভাবনা চমৎকার। তবে ছবিতে বাণিজ্যিক মোড়কের বিনোদনের উপকরণ নেই প্রায়, সকলের ভাল লাগার নয়। তার ওপর ছবিটার গতি বেশ শ্লথ।
প্যানডেমিকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ছবির চিত্রনাট্য। বিধ্বস্ত মানুষের জীবন, তাদের অসহায়তা, মারণ রোগের প্রকোপ এবং চিকিৎসকদের অনিবার্য ভূমিকা টাইমলুপে মোড়া ছবির কাহিনির প্রাথমিক বিষয়। লকডাউনে ঠিক যেটা হয়েছিল আমাদের, ঘরে বন্দি থাকতে থাকতে দিন-সময়ের হিসেব ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছিল, এই ছবিতে তার সুস্পষ্ট ছাপ রয়েছে। শুরুতেই দেখি একটি মেয়ের চিকিৎসককে প্রয়োজন কারণ বাড়িতে বয়স্ক মামণি তার। চিকিৎসক আসতে অরাজি হওয়ায় অন্য পন্থা নেয় মেয়েটি। তারপর ডাক্তারকে বাড়িতে এনে প্রায় আটক করে ফেলে। তিনজন একই নামের চরিত্র– বড় মামণি (শ্রীলেখা মুখোপাধ্যায়), মেজ মামণি (তন্নিষ্ঠা বিশ্বাস), ছোট মামণি (অহনা কর্মকার)। প্রত্যেকে পরস্পরকে ‘মামণি’ সম্বোধন করে। সংসারের হাল ধরেছে মেজ মামণি। কারণ মা বয়স্কা, আর কন্যা ছোট। এবার ডাক্তার (জনার্দন ঘোষ) এসে জুড়ে যায় তাদের জীবনে। এরা সকলেই গৃহবন্দি। বড় মামণির অ্যামনেশিয়া। দিনের একঘেয়ে রুটিনে একই কথা রোজই বলে মেজ মামণি এবং ছোট মামণিও। অতিমারী যে ভাবে আমাদের মানসিক সুস্থতায় আক্রমণ শানিয়েছে, একেবারে তার প্রতিচ্ছবি পর্দায়। বন্দি ডাক্তার মাঝে মাঝে ছোটটির সঙ্গে কথা বলে আর বড় মামণির কাশি-শ্বাসকষ্ট বাড়লে তাকে পাশের ঘরে দেখতে যায়। সারাক্ষণই মেজ মামণি আতঙ্কিত এই বুঝি ‘বড় মামণি’ বাইরে বেরিয়ে রোগ বাধাল! হরর ছবির মতোই কী হয়-কী হয় ভাব ছবি জুড়ে। তবে অনিবার্যভাবে একই জায়গায় জীবনটা ঘুরপাক খায়। নষ্ট হতে থাকে পারস্পরিক ভরসা। ছোট্ট মেয়েটি সকালে সুকুমার রায়ের ছড়া মুখস্থ করে আর জানলা দিয়ে বন্ধুকে (দীপ সরকার) দেখলেই বলে, ‘তুই মাস্ক পরিসনি কেন?’ বন্ধুও অবলীলায় বলে, ‘ওসব বড়লোকের রোগ।’ একটু একটু করে সংক্রমণ ছড়ায়, আর মৃত্যু বৃদ্ধির খবর ঘনায়। উঠে আসে পরিযায়ী শ্রমিকের ঘরে ফেরার যন্ত্রণা। মেজ মামণির বহুদিন ঘরে না ফেরা প্রেমিকের চরিত্রে (অমিত সাহা), তার মুখে একটা মনছোঁয়া সংলাপ আছে। অনেকটা এইরকম– বড়লোকেরা প্লেনে ফিরবে, ছোটলোকেরা পায়ে হেঁটে। আমরা তো মাঝারি। সময় যেন থমকে গিয়েছে, রয়েছে মহাবিনাশের অপেক্ষা। একঘরে থাকতে-থাকতে কী হয়–তিন মামণি ও ডাক্তারের, সুরিয়্য়াল জার্নিটা ছবিতে দেখাই ভাল। সময় নিয়ে খেলা করেছেন পরিচালকদ্বয়। এই রিপিটেটিভ মেজাজ দর্শক কতটা ধরতে পারবেন বলা মুশকিল।
এই ছবি আর পাঁচটা ছবির থেকে একেবারেই আলাদা, খুবই সিরিয়াস ধাঁচের। সাউন্ড ডিজাইন ও সিনেমাটোগ্রাফি প্রশংসার দাবি রাখে। তন্নিষ্ঠা বিশ্বাস ভাল অভিনয় করেছেন মেজ মামণির চরিত্রে। তার বদমেজাজ, অসহয়তা, ভীতি ঠিকঠাক তুলে এনেছেন তিনি। ভাল লাগে জনার্দন ঘোষ ও অমিত সাহাকেও। শর্মিষ্ঠা-রাজদীপের পরিচালনার গুণে চিত্রনাট্যের ‘প্যানিক স্ট্রিকেন’ ভাবটা চমৎকার উঠে এসেছে। ছবিটা দেখার পর মনে ঘুরতে থাকে, সময়কে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, না কি সময়ই আমাদের নিয়ন্ত্রক? ভয়ের আবর্তে আটকে যাব, না কি উত্তরণের পথ ঠিক খুঁজে পাবে মানুষ, মনে হতে থাকে। এখন দেখার দর্শক কীভাবে গ্রহণ করেন এই ছবি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.