শম্পালী মৌলিক: নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশ। তাঁর লেখা পড়তে পড়তে আজও চমকে যেতে হয় কবিমনের তীব্র সংবেদনশীলতার অভিঘাতে। সোশ্যাল মিডিয়া-স্মার্টফোন নিয়ন্ত্রিত এই জীবনেও ক্ষণিকের শান্তায়ন এনে দেয় তাঁর সৃষ্টি। তাঁরই জীবন-আধারিত ছবি ‘ঝরা পালক’ মুক্তি পাচ্ছে আজ। কবির বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের নামেই এই ছবির নামকরণ। পরিচালনায় সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়। জীবনানন্দর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘মাল্যবান’। যেখানে কবি নিজে তাঁর জীবনকে বিশ্লেষণ করেছেন। রয়েছে স্ত্রী লাবণ্যপ্রভা দাশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের চড়াই-উতরাই। খানিকটা সেই বিষয় অবলম্বন করে এই ছবি।
তবে ছবির বিন্যাস যথেষ্ট জটিল এবং বহুস্তরীয়। মধ্য বয়সের জীবনানন্দর চরিত্রে ব্রাত্য বসু, কম বয়সের কবির ভূমিকায় রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায় আর লাবণ্যপ্রভার চরিত্রে জয়া আহসান। কবির বহু-পঠিত কবিতায় বা তাঁর স্বল্প-পঠিত উপন্যাসগুলোতে যেমন একাধিক সাব-টেক্সট-এর স্পষ্ট ছায়া পাওয়া যায়, তেমনই এই বায়োপিকের চলন। নন-লিনিয়ার গল্প বলার ধরন। দর্শকের ধরতে সময় লাগবে। কখনও তরুণ জীবনানন্দ, কখনও প্রবীণ কবি, আবার কখনও একেবারে এই সময়ের একটি লোক আসবে, যাকে দেখতে একেবারেই জীবনানন্দর মতো, ধাঁধার সৃষ্টি করবে! মনে পড়বে ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে’ কবিতার লাইনটি। তাহলে কি কবিরই পুনর্জন্ম– প্রশ্ন জাগবে কারও মনে, যার সুস্পষ্ট আভাস আছে ছবিতে। সেখানে পরিচালক দু’টি চরিত্র এনেছেন –সোমেন (ব্রাত্য বসু) ও সুরঞ্জনা (জয়া আহসান)। যারা এই যুগের। সুরঞ্জনা জীবনানন্দর জীবন নিয়েই ছবি বানাচ্ছে। অন্যদিকে সোমেনকে ক্রমশ গ্রাস করছে মৃত্যুচিন্তা, কবিরই মতো। সুরঞ্জনা তো অবিকল লাবণ্য! এখানে সময় নিয়ে খেলা করেছেন পরিচালক। তিনি দেখিয়েছেন লেখকের স্ট্রাগল, স্ত্রীর গঞ্জনা সহ্য করে যাওয়া, অর্থকষ্টের সঙ্গে নিরন্তর লড়াই এবং যুগের স্রোত-বিরোধী অসামান্য যাত্রাকেও তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন প্রায় দেড় ঘণ্টার ছবিতে। ট্রাম লাইনের ব্যবহার এবং স্বপ্নদৃশ্যগুলো ভাল লাগে। সেই সময়ের নক্ষত্ররা ঘুরে-ফিরে এসেছেন টুকরো টুকরো দৃশ্যে, রয়েছে কবিগুরুর অমোঘ উপস্থিতিও। সজনীকান্ত দাস (দেবশংকর হালদার), বুদ্ধদেব বসু (কৌশিক সেন), প্রেমেন্দ্র মিত্র (বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (পদ্মনাভ দাশগুপ্ত), ডি.কে গুপ্ত (পবন কানোরিয়া), সমর সেন (সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়) প্রমুখকে কিছু দৃশ্যে পাওয়া যায়। আসলে এত কম সময়ে জীবনানন্দকে ধরা দুরূহ কাজ। পরিচালক নিঃসন্দেহে বড় চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। কাব্যশিল্পের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে এ এক অনন্য প্রয়াস।
অভিনয়ের প্রসঙ্গে আসি। জীবনানন্দর ভূমিকায় ব্রাত্য বসু অবিকল্প। কবির অন্তর্মুখী স্বভাব এবং ব্যাখ্যাতীত ভাব প্রকাশে তিনি চমৎকার। তরুণ কবির ভূমিকায় রাহুল এত সাবলীল, মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়। লাবণ্যপ্রভার চরিত্রে জয়া স্বামীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের জটিলতা বা তিক্ততা দারুণ ফুটিয়ে তুলেছেন। সাদা-কালো ও সিপিয়া টোনে ছবির সিংহভাগ। মাঝে মাঝে রঙিন দৃশ্যের অবতারণা ভাল ভাবনা। ব্রাত্য এবং জয়া দু’জনেই চরিত্র হিসাবে তাঁদের সম্পর্কের দূরত্ব, ভায়োলেন্স, নির্লিপ্তি অপূর্বভাবে ধরতে পেরেছেন। সব মিলিয়ে ছকভাঙা এ ছবির চলন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.